স্কুল পড়ুয়া আরাফাত রহমান খান রোহান এক বছরে আগে এই ডিসেম্বরেই হারান বাবাকে। বছরের শুরুতে দাদাকে হারিয়ে মা ছিলেন তার একমাত্র অবলম্বন।
ভরসা হয়ে থাকা মা-ও চলে গেলেন শুক্রবার বিকালের মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনা।
এত ছোট বয়সে অল্প সময়ের ব্যবধানে পরিবারের একের পর এক সদস্য হারিয়ে নির্বাক ক্যাথলিক স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী রোহান।
স্বামী, শ্বশুর আর দেবরকে হারানো সামলে শিশু রোহানকে নিয়ে চলছিল রুবিনা আক্তারের (৪৫) জীবন।
ঢাকার তেজকুনিপাড়ায় স্বামীর পৈত্রিক চার তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকতেন রুবিনা। তার ননদ ডলির পরিবারের সদস্যরাও থাকতেন তাদের সঙ্গে। স্বামী ও শ্বশুর চলে যাওয়ার পর এদেরকে ঘিরে চলছিল তাদের যাপিত জীব্ন।
রাজধানীর শাহবাগে চাপা পড়ার পর একটি প্রাইভেট কার তাকে টেনে হেঁচড়ে এক কিলোমিটার নিয়ে গেলে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় রুবিনার। এ খবর পরিবারের কাছে পৌঁছালে হৃদয়বিদারক দৃশ্য তৈরি হয়।
অথচ এর কিছু সময় আগেই তেজগাঁও তেজকুনিপাড়ার বাসা থেকে বের হওয়ার সময় নিচতলার ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে গল্প করেছেন সবার সঙ্গে মিশুক রুবিনা; বলে যান- ‘তোরা থাক, আমি আসছি’।
ননদের স্বামী নুরুল আমিনের সঙ্গে মোটরসাইকেল করে হাজারীবাগে ভাইয়ের বাসায় যাচ্ছিলেন রুবিনা। পথেই ঘটে এ দুর্ঘটনা।
নুরুল আমিন বলেন, এই শিশুর তো আর কেউ রইল না। এত কম বয়সে বাবা-মা দুজনকেই হারাল।
বোনকে হারিয়ে হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়েন রুবিনার ভাই জাকির হোসেন। তার বাসাতে যাওয়ার পথেই ঘটে এ দুর্ঘটনা। এখন রোহানের কী হবে- বলে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি।
তেজকুনিপাড়ার চার তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকতেন রুবিনা। ওই তলাতেই থাকেন তার ননদ ডলি ও তার স্বামী নুরুল আমিন।
শুক্রবার রাতে ওই ভবনের দোতলায় শুধু ডলিকে পাওয়া গেলেও ঘর ছিল অন্ধকার, ভাবিকে হারিয়ে কথা বলার মত অবস্থায় ছিলেন না তিনি।
স্বজনরা এসময়ে আগলে রেখেছেন রুবিনার একমাত্র সন্তান রোহানকেও।
তেজকুনি পাড়ায় চারতলা ভবনটির বাকি তলায় দুটি করে ইউনিট ভাড়া দেওয়া। নিচতলায় পাঁচ বছর থেকে ভাড়া থাকেন ইসমাইল হোসেন বাদল।
তিনি জানান, এক শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরেক শোকে পড়ছে পরিবারটি।
অসুস্থার কারণে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মারা যান রুবিনার স্বামী ও রোহানের বাবা মাহবুবুর রহমান খান ডলার। পরের মাস জানুয়ারিতে রোহানের দাদা খান আতাউর রহমানের মৃত্যু হয়। আর মেজ চাচা ডন মারা যান ২০২১ সালের শুরুতে। তার ছোট চাচা ডেভিড চাকরি সূত্রে টাঙ্গাইলে পরিবারসহ বসবাস করেন।
বাদলের মা হাজেরা খাতুন বলেন, স্বামী, শ্বশুর ও দেবরকে হারানো রুবিনা নিজের সংসারের পাশাপাশি পুরো পরিবারটিকে সামাল দিচ্ছিলেন। ভাড়াটিয়া হলেও আমাদের সঙ্গে খুব মিশত।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, যে সব কিছু দেখভাল করতেন, তার এ ছোট ছেলেকেই দেখার আর কেউ রইলো না।
হাজেরা খাতুনের কথা বলার সময় অন্য ভাড়াটিয়া আসেন সেখানে। এসময় রুবিনাকে টেনে হেঁচড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সেই প্রাইভেট কারের দৃশ্য দেখে কান্নার রোল ওঠে।
ভাড়াটিয়া বাদল বলেন, “যখন রুবিনা আপু বাসার নিচে মোটরসাইকেলে উঠতেছিল, তখন আমাকে বলে, ‘তোরা থাক আমি আসতেছি’।“
দুর্ঘটনার পর প্রাইভেটকারে আটকে থাকে রুবিনার দেহ। আর মরিয়া চালক ওইভাবেই গাড়িটি চালিয়ে নিলেন প্রায় এক কিলোমিটার। উত্তেজিত জনতা গাড়ি আটকে নিচ থেকে বের করে ক্ষতবিক্ষত ওই নারীর লাশ। পিটুনিতে আহত চালককেও হাসপাতালে পাঠাতে হয়।
শাহবাগ থানার ওসি নূর মোহাম্মদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শুক্রবার বিকাল ৩টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটায় গাড়িটি।
প্রাইভেট কারটি চালাচ্ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আজাহার জাফর শাহ। তখন গাড়িতে তিনি ছাড়া আর কেউ ছিল না।
তিনি বলেন, রুবিনা ছিলেন একটি মোটরসাইকেলে। জাফরের গাড়ির ধাক্কায় তিনি ছিটকে চলে যান ওই গাড়ির নিচে। পেছন ও আশপাশের থেকে অনেকে চিৎকার করলেও চালক গাড়ি থামাননি। এক কিলোমিটার ছেঁচড়ে যাওয়ার পর রুবিনাকে আর বাঁচানোর উপায় ছিল না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সোশাল মিডিয়ায় আসা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক নারী একটি প্রাইভেট কারের বাঁপাশে আটকে রয়েছেন। পেছনের বাইকাররা চিৎকার করে গাড়ি থামাতে বলছেন, কিন্তু গাড়ি চালক দ্রুত গতিতে চালিয়েই যাচ্ছেন।
নীলক্ষেত মোড়ে মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ পার হতেই সামনে একটি অটোরিকশা এসে পড়ায় গতি কমাতে বাধ্য হন গাড়ি চালক। জনতা তখন গাড়িটি ঘিরে ফেলে।
ওসি নূর মোহাম্মদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জনতা গাড়িটি আটক করে চালককে ধোলাই দেয়। চালক জাফরের অবস্থাও ভালো না। তাকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে।”