শব্দ দূষণ নিয়ে সচেতনতা গড়তে আগামী রোববার সকাল ১০টায় রাজধানীতে ‘এক মিনিট শব্দহীন’ কর্মসূচি পালন করবে সরকার।
Published : 12 Oct 2023, 03:42 PM
শব্দ দূষণ নিয়ে মানুষকে সচেতন করতে আগামী রোববার রাজধানীতে বিশেষ এক কর্মসূচিকে সামনে রেখে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনের সময় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছিল উচ্চ শব্দের হর্ন।
পরিবেশ সচিব ফারহিনা আহমেদ সেখানে মানুষের অসচেতনতার কথা উল্লেখ করে হতাশা প্রকাশ করেন। বলেন, শব্দ দূষণকারীর সংখ্যা এত বেশি যে, সবাইকে আইনের আওতায় আনা হলে ‘সারা দেশের কারাগারে ঠাঁই হবে না’।
শব্দ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মানুষকে মুক্ত রাখতে সচেতনতা গড়ার চেষ্টার অংশ হিসেবে আগামী রোববার সকাল ১০টায় রাজধানীতে ‘এক মিনিট শব্দহীন’ কর্মসূচি পালন করবে সরকার। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে বৃহস্পতিবার নিজের মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন আসেন পরিবেশ সচিব।
তিনি বলেন, “এই রুমের ভেতরে যে ডেসিবলে শব্দ বাইরে থেকে আসছে এটি কিন্তু মানমাত্রার উপরেই। ফলে আমরা যদি আইন প্রয়োগ করতে যাই, যদি আমরা দূষণমুক্ত মান নিশ্চিত করতে যাই, দেখবেন যে সারা দেশকে আমার কারগারে পরিণত করতে হবে। এটা তো করা যাবে না।”
আইন মানার বেশিরভাগ মানুষের আগ্রহ থাকার গুরুত্বের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “সরকার এনফোর্স করবে, নাগরিকরা মেনে চলবে, স্টেকহোল্ডাররা মেনে চলবে। দুই পক্ষ যখন একটা জায়গায় আসবে তখনই কিন্তু কপ্লায়েন্ট হবে।”
দূষণের মাত্রা ব্যাপক
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ২০০৬ সালে করা হয় ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা’। এতে রাজধানীতে শব্দের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা সময় ও এলাকাভেদে আলাদা করে দেওয়া আছে।
নীরব এলাকায় রাতে সর্বোচ্চ মাত্রা ৪০ ডেসিবল আর দিনে ৫০। আবাসিক এলাকায় রাতে ৪৫ ও দিনে সর্বোচ্চ ৫৫ ডেসিবল শব্দ করা যাবে।
হর্নের অত্যাচার: যাদের দেখার কথা, কানেই যেন যায় না তাদের
মিশ্র এলাকায় যথাক্রমে ৫০ ও ৬০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৬০ ও ৭০ ডেসিবল শব্দ গ্রহণযোগ্য। শিল্প এলাকায় তা রাতে ৭০ এবং দিনে সর্বোচ্চ ৭৫ ডেসিবল শব্দ করা যাবে।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেসের নন কমিউনিকেবল ডিজিজ বিভাগের চিকিৎসক সাইকা নিজাম ২০২০ সালে শব্দ দূষণ নিয়ে রাজধানীতে একটি গবেষণা করেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে হর্নের শব্দ পেয়েছেন গড়ে ৯৫ ডেসিবল আর দক্ষিণ সিটিতে ৯৬।
গত ১ ফেব্রুয়ারি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি বিশেষ অভিযানে পাঁচটি গাড়ি পরীক্ষা করে একটিতে শব্দের মাত্রা পাওয়া যায় ১১০ ডেসিবল। অন্য চারটি ছিল যথাক্রমে ১০১, ৯৯, ৯৮ ও ৯৭।
পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণায় কর্মদিবসে সচিবালয় এবং আশেপাশের এলাকায় দিনের বেলায় ১২৪ ডেসিবলের কম মাত্রায় শব্দ পাওয়া যায়নি।
সচিবের কণ্ঠে হতাশা, আইন প্রয়োগে ‘জটিলতা’
প্রায় দেড় যুগ আগে বিধিমালা করে সেটি কার্যকর করতে না পারার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পরিবেশ সচিব বলেন, “যদি আমরা এখন বিধিমালা প্রয়োগ করি, আমাদের জেলখানায় ঠাঁই হবে না, একেবারে প্রত্যেকেই ভায়োলেটর।”
তিনি বলেন, “আইনটি সকলকে সমানভাবে জানতে হবে, বুঝতে হবে। যারা সড়কে চলাচল করবেন তাদের জানা-বোঝার জায়গাটা এখনও রেডি হয়নি।
“আমরা করছি, জরিমানা করছি। কিন্তু মোবাইল কোর্ট করলে যানজট হয়। … আমরা যদি প্রতিটি রাস্তায় মোবাইল কোর্ট করতে যাই, দেখবেন যে ঢাকা শহরে চলাচলে অসুবিধা। ফলে বাস্তবতার নিরিখে আমরা এনফোর্সমেন্টে যেতে পারছি না।
“সেজন্য আমরা জনগণের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছি যে আইনটা উনারা জানুক, কত মানমাত্রা উনারা করতে পারবেন।”
উচ্চ শব্দের হর্ন কীভাবে বাজারে?
আমদানি নিষিদ্ধ হলেও হাড্রলিক হর্ন দেশে বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য হর্নের শব্দ উৎপাদন ক্ষমতাও সরকার নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি থাকার বিষয়ে এক প্রশ্নে পরিবেশ সচিব বলেন, “হাইড্রলিক হর্নের বিষয়েও আমরা কাজ করছি, জব্দ করছি।
“আমদানি নিষিদ্ধ এসব পণ্য কীভাবে আসে সে বিষয়ে এনবিআরের সঙ্গে কাজ করছি। বিপণনকেন্দ্রগুলো থেকে আমরা জব্দ করছি। লোকালি উৎপাদন হচ্ছে, সেসব উৎস বন্ধে কাজ করছি। ব্যর্থ বলব না, প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
শব্দ দূষণের প্রধান উৎস হিসেবে পরিবহন খাতকে চিহ্নিত করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “গাড়ি চলাচল ও অযথা হর্ন বাজানোয় শব্দ দূষণ হয়। নির্মাণ খাত, কলকারখানা থেকেও শব্দ দূষণ হচ্ছে।
“পরিবহন খাত থেকে সব থেকে বেশি শব্দ দূষণ হওয়ায় বিআরটিএ ও বিআরটিসির সঙ্গে পরিবেশ মন্ত্রণালয় কাজ করছে।”
সরকারি গাড়ি চালকদের ‘শপথ’
সচিবালয়ের ভেতরে কেউ হর্ন বাজালে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়ে সরকারি চালকদের সচেতন করতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার কথাও জানান সচিব।
তিনি বলেন, “সিরডাপে আমরা কর্মশালা করেছি। সেখানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব প্রধান অতিথি ছিলেন। পরিবহন পুল তাদের আওতায়। তাদের যত ড্রাইভার ছিল তাদের মাধ্যমে মেসেজ দিয়েছেন, একটি শপথ বাক্য পাঠ পড়িয়েছেন।”
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারত্বমূলক প্রকল্পের’ আওতায় পরিবহন চালক, কারখানা ও নির্মাণ শ্রমিক, সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাংবাদিক, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, ইমাম, শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। থিম সং, টিভিসি, রেডিও ড্রামা ও ডকুমেন্টারি নির্মাণ ও প্রচার করা হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচারের পাশাপাশি শব্দ সচেতনতামূলক বিলবোর্ড, সাইন বোর্ড স্থাপন, লিফলেট, স্টিকার, মূদ্রণ ও বিতরণ করা হচ্ছে।
'১ মিনিট শব্দহীন'
‘শব্দদূষণ বন্ধ করি, নীরব মিনিট পালন করি’ স্লোগানে এই কর্মসূচি পালন করা হবে ঢাকার ১১টি স্থানে।
এলাকাগুলো হলো: ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সামনের রাস্তা, শাহবাগ মোড়, উত্তরা, বিজয় সরণী মোড়, মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর, গাবতলী, মগবাজার, মহাখালী, গুলশান-১, কমলাপুর, বৌদ্ধমন্দির ও যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা।
সেদিন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্কুল-কলেজের স্কাউট সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারি দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী, ট্রাফিক পুলিশ ও পরিবহন মালিক সমিতির সদস্যরা ব্যানার, ফেস্টুনসহ উপস্থিত থেকে মানববন্ধন করবেন। এরপর গাড়ি চালকদের মধ্যে শব্দ সচেতনতামূলক লিফলেট, স্টিকার বিতরণ করা হবে। তাদেরকে হর্ন না বাজানোর অনুরোধ করা হবে।