“বেসরকারিকরণ করা হলে শিক্ষা ও চিকিৎসার কোন গুণগত মানের পরিবর্তন হয় না, তখন সেটা হয়ে যায় একটা পণ্য”, বলেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য প্রাণ গোপাল দত্ত।
Published : 22 Jun 2024, 09:26 PM
বেসরকারি হাসপাতালে রোগ পরীক্ষা ও চিকিৎসার উচ্চ খরচ নিয়ে সংসদে উচ্চকণ্ঠ হলেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রাণগোপাল দত্ত।
শিক্ষা ও চিকিৎসা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতে গিয়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের উক্তি তুলে ধরে তিনি বলেছেন, বেসরকারি খাতে শিক্ষা ও চিকিৎসা আর সেবা নেই, পণ্য হয়ে গেছে।
শনিবার প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে কুমিল্লা-৭ আসনের সংসদ সদস্য এসব কথা বলেন।
২০২১ সালের ৭ অক্টোবরের উপনির্বাচনে দেশের খ্যাতনামা নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ প্রাণগোপাল দত্তকে মনোনয়ন দেওয়ার পর জিতে আসেন তিনি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
বাজেট আলোচনায় তিনি বলেন, “সবচেয়ে ব্যয়বহুল হচ্ছে স্বাস্থ্য খাত, যেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণা, চিকিৎসা উপকরণের দাম আকাশচুম্বী।
“নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ভাষায় শিক্ষা ও চিকিৎসা থাকা উচিত সরকারি খাতে। একে বেসরকারিকরণ করা হলে শিক্ষা ও চিকিৎসার কোন গুণগত মানের পরিবর্তন হয় না, তখন সেটা হয়ে যায় একটা পণ্য। এখন পৃথিবীজুড়ে এটা পণ্য হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে আপনার টাকা আছে চিকিৎসা পাবেন, টাকা না থাকলে চিকিৎসা পাবেন না।”
“বাংলাদেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য দেখার কিছু নেই”, বলেও মন্তব্য করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য।
দেশের চিকিৎসা সেবার উন্নতির জন্য চিকিৎসকদের বেতন ভাতার পাশাপাশি গবেষণা, আবাসনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তাব করেন প্রাণ গোপাল।
মোবাইল ফোনের অপব্যবহারের কারণে নতুন প্রজন্মের ক্ষতির আশঙ্কার কথাও তুলে ধরেন এই নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, “কোনো একটা অ্যাপ সৃষ্টি করে রাত দশটা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলে মোবাইল টাওয়ারগুলো নিষ্ক্রিয় করা যায় কি না? অথবা সেই মোবাইল টাওয়ার যাতে ফ্রিল্যান্সিং বা বিদেশি মুদ্রা অর্জনের বিকল্প ছাড়া অন্যান্য কোনো ক্ষেত্রে ব্যবহার না হয় সেক্ষেত্রে আমাদের নজর দেওয়া উচিত। না হয় আমার রোগীর সংখ্যা যে হারে বাড়ছে…
“১০ বছর থেকে শুরু করে সবার একটাই কথা, ‘কানে শোঁ শোঁ করে, ভোঁ ভোঁ করে, কানে শুনি না, লেখাপড়ায় মন দিতে পারি না’। তাই এমন কোনো কিছু আবিষ্কার করা উচিত যাতে করে রাত ১০ টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত আমাদের তরুণ প্রজন্ম এ প্রযুক্তি হতে দূরে থাকবে।”
চিকিৎসা খাত নিয়ে কথা বলেন গত দুই মেয়াদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও। মানিকগঞ্জ-১ আসনের এই সংসদ সদস্য বলেন, “বিদেশে চিকিৎসা নিতে ৫-৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, যা রিজার্ভের উপর চাপ ফেলছে।”
হুন্ডি ও বেটিং সাইট বন্ধের দাবি
যশোর-৬ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আজিজুল ইসলাম বলেন, “সরকার যদি টাকা পাচার, হুন্ডি ও বেটিং সাইট বন্ধ করে দিতে পারে তাহলে ছয় মাস নয়, তিন মাসের মধ্যে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।“
দেশে নামে-বেনামে অনেকগুলো বেটিং সাইট আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “নিম্ন আয়ের মানুষেরাও তাদের অর্থ খোয়াচ্ছে। দেশের হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
“এতে নষ্ট হচ্ছে মানুষের সুখের সংসার, যার পেছনে আছে জুয়া। সবকিছু আমাদের চোখের সামনে হচ্ছে।”
‘টাকা পাচারকারী দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার এখনই সময়’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা মঈন উদ্দিন কথা বলেন টাকা পাচার নিয়ে।
তিনি বলেন, “কতিপয় দুর্নীতিবাজ আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীর জন্য বাংলাদেশের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। কানাডার বেগমপাড়ায়, আবুধাবি, মালয়েশিয়াতে হাজার সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তারা।
“যারা দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে চায়, তাদের দায়দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা এবং এ সংসদ নিতে পারে না। বৈধ রেমিটেন্সের মাধ্যমে যাতে এ টাকা ফেরত আসে সেই উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানাব।”
টাকা পাচারকারীদের ‘দুষ্কৃতকারী’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই সময়। প্রধানমন্ত্রী এটা করবেন বলে আশা করি।”
‘কালো টাকা’ সাদা করার সুযোগের পক্ষে-বিপক্ষে
অর্থমন্ত্রী তার প্রস্তাবিত বাজেটে ‘কালো টাকা’ নামে বহুল পরিচিত অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করা বা সাদা করার যে সুযোগ রেখেছেন, তার পক্ষে ও বিপক্ষে কথা হয় এদিনও।
প্রাণগোপাল দত্ত এই সুযোগ দেওয়ার বিপক্ষে। তিনি বলেন, “আমার ৩০ লাখ টাকা থাকলে ৩০ শতাংশের বেশি কর দিতে হচ্ছে। কিন্তু যিনি গত বছর টাকা দেখাননি, ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সেই অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ করে নিচ্ছেন। এতে করে সঠিক করদাতারা কর দিতে অনিচ্ছা পোষণ করবেন।”
তিনি বলেন, “সব সময় কালো ও সাদা টাকা নিয়ে কথা বলা হলেও ইনফরমাল গ্রে-মানি (অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি), যার কর দেওয়া হয় না, যাকে কোনো অবস্থায় নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, সেটা নিয়ে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় কিছু বলেননি।
“গ্রে-মানি অপ্রদর্শিত আয়ের চেয়েও অনেক খারাপ। একে সংকুচিত না করা হলে অর্থ পাচার বন্ধ করা যাবে না।”
জাহিদ মালেক বলেন, “কালো টাকার মালিক হচ্ছে অভিজাতরা, কোটি কোটি কৃষক কালো টাকার মালিক না, যারা শিল্প-কল-কারখানা তৈরি করে তারা কালো টাকা তৈরি করে না। প্রবাসীরা কালো টাকার মালিক না, অভিজাতরাই কালো টাকা তৈরি করে। কালো টাকার বিষয়ে নজর দিতে হবে।”
যে টাকা বিদেশে চলে গেছে তা আনা গেলে অর্থনীতি কিছুটা হলেও চাঙা হত মত দিয়ে তিনি বলেন, “কালো টাকা কমাতে হলে দুর্নীতি কমাতে হবে, ট্যাক্স কমাতে হবে। কালো টাকার জন্ম না নিলে টাকা পাচারও হবে না।”
বিদেশি চকলেট আমদানিতে কর কমানোর প্রস্তাবের সমালোচনা করে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “অর্থমন্ত্রীর নাতি-নাতনিরা হয়ত বিদেশি চকলেট পছন্দ করে, তাই ট্যাক্স কমাতে পারেন।”
সংরক্ষিত নারী আসনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য নুরুন নাহার বেগম বলেন, “কালো টাকা সাদা করার বিধান রাখলে কর দিতে অনীহা তৈরি হবে। করদাতাদের কাছে করের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার বিকল্প রয়েছে।”
এসব বক্তব্যের জবাব দেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। তিনি বলেন, “বাস্তবতা হচ্ছে কালো টাকা আমাদের মার্কেটে আছে। এ টাকা কীভাবে ব্যবহার করবেন সেই উপায় কেউ বাতলায় না, সমালোচনা করে।
“দেখলাম বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমালোচনা করে বলছেন, এতে নাকি দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু উনি বলেন না ২০০৭ সালে ওনার নেত্রী খালেদা জিয়া ৫ শতাংশ কর দিয়ে ১ কোটি ৩৩ লাখ ১৪ হাজার ৭১০ টাকা সাদা করেছেন। এটা বলেন না, এটা তাদের মনে থাকে না। এটা মনে রাখার জন্য বলব।”