অনেকেই সন্তানদের নিয়ে জাদুঘরে যান ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে। জাদুঘরে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার কোন ইতিহাস জেনে তারা বাড়ি ফেরেন?
Published : 26 Mar 2025, 01:55 AM
মেয়ের প্রশ্ন, “এটা কে মরে গেছে বাবা?”
বাবার উত্তর, “মতিউর রহমান”।
মেয়ের পাল্টা প্রশ্ন, “মতিউর রহমান কে বাবা?”
বাবার উত্তর, “উনি বীরশ্রেষ্ঠ– মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন।”
ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বর এলাকা থেকে নিজের ৫ বছর বয়সী মেয়ে পূর্বিতা প্রীতিকে নিয়ে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরে এসেছিলেন সরকারি চাকরিজীবী মাজহারুল ইসলাম। ঘুরে-ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের নানা নিদর্শন আর ছবির গল্প মেয়েকে তিনি বলছিলেন।
এক পর্যায়ে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম: বাঙালি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ’ নামে ৩৮ নম্বর গ্যালারিতে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের পোশাক, র্যাংক ব্যাজ দেখার পর মেয়ে প্রশ্ন করছিল, উত্তর দিচ্ছিলেন বাবা।
জানতে চাইলে মাজহার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “আমি ছুটিতে আছি আজকে। তো, মেয়েটার সাথে সময় কাটানোর জন্য বেরিয়েছি। এটা আমি ব্যক্তিগতভাবে আগে দেখে গেছি, মুক্তিযুদ্ধের গ্যালারিটা আমার আগ্রহের জায়গা। ও দেখল, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে পরিচিত হল, এজন্য আসা।”
এই গ্যালারিতে থাকা ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের’ আদলে তৈরি কক্ষের সামনে দেখা হয় জুরাইন থেকে আসা আরেক পরিবারের সঙ্গে।
সুমন বর্মণ নামের ওই ব্যক্তি থাকেন রাজধানীর জুরাইন এলাকায়। পরিবার নিয়ে এসেছেন জাদুঘরে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার ঠাকুরদা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। সেই মুক্তিযুদ্ধকে আমি ধারণ করি। আমার দুই ছেলের একজন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। আরেকজন চতুর্থ শ্রেণিতে। ওদের মুক্তিদুদ্ধের সঙ্গে আরও নিবিষ্টভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে আসা।
“এখানে এসে প্রথম ভাষা শহীদ শফিউর রহমানের রক্তমাখা ব্লেজার, শার্ট, জুতো দেখেছি। এটার অনুভূতি যে কেমন সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। দেখেছি আমার স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি। এসব স্মৃতি আর ইতিহাসকে পরের প্রজন্মের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করে দিতেই আসা।”
নিজের দুই পুত্র তাহসান আহমেদ আর তাসিন আহমেদকে নিয়ে জাদুঘরে এসেছিলেন আফজাল হোসেন। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসিনের কাছে জানতে চাইলে সে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, “মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত পিস্তল (রাইফেল) দেখেছি। মতিউর রহমানের কথা পড়েছি বইয়ে। এখন দেখেছি।”
আফজাল হোসেন বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের এমন কিছু নিদর্শন আছে, যেগুলো জাদুঘর ছাড়া আর কোথাও দেখা সম্ভব হতো না। একটা শিশুকে নিজেদের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি।”
মাজহার, সুমন, তাহসানের মতই অনেকে তাদের সন্তানদের নিয়ে জাদুঘরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। কিশোর-তরুণ শিক্ষার্থীরাও আসেন। জাদুঘরে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার কোন ইতিহাস জেনে তারা বাড়ি ফেরেন?
যা আছে জাদুঘরে
১৯১৩ সালের ২০ মার্চ শাহবাগের জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়, সে বছর ৭ অগাস্ট আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ১৯৮৩ সালের ১৭ নভেম্বর এটি জাতীয় জাদুঘরের মর্যাদা পায়।
আট একর জমির ওপর নির্মিত চারতলা ভবনটিতে নৃতত্ত্ব, চারুকলা, ইতিহাস, প্রকৃতি এবং আধুনিক ও প্রাচীন বিশ্ব-সভ্যতা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ে আলাদা ৪৫টি প্রদর্শনশালা (গ্যালারি) রয়েছে। এছাড়া একটি সংরক্ষণাগার, গ্রন্থাগার, মিলনায়তন, সিনেপ্লেক্স ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনালয় রয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের নকশা করেছেন প্রখ্যাত স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন। জাদুঘরে নিদর্শনাগুলোর কয়েকটি বিভাগ রয়েছে। এগুলো হল– ‘ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা’, ‘জাতিতত্ত্ব ও অলঙ্করণ শিল্পকলা’, ‘সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা’, ‘প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগ’, ‘সংরক্ষণ গবেষণাগার’ এবং ‘জনশিক্ষা বিভাগ’।
এই জাদুঘরে সংগৃহীত নিদর্শনের সংখ্যা প্রায় ৯৪ হাজার বলে দাবি করা হয়। তবে জনসাধারণের দেখার জন্য সাজিয়ে রাখা আছে ৫ হাজারের মত নিদর্শন ।
এর মধ্যে প্রথম তলায় মানচিত্রে বাংলাদেশ, গ্রামীণ বাংলাদেশ, সুন্দরবন, শিলা ও খনিজ, বাংলাদেশের গাছপালা, ফুলফল, লতা পাতা, জীবজন্তু, পাখি, বাংলাদেশের স্তন্যপায়ী প্রাণী, হাতি, বাংলাদেশের জনজীবন, বাংলাদেশের নৌকা, বাংলাদেশের ‘ক্ষুদ্র’ নৃ-গোষ্ঠী, বাংলাদেশের মাটির পাত্র, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, লেখমালা, মুদ্রা, পদক ও অলঙ্কার, হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম রয়েছে।
দ্বিতীয় তলায় অস্ত্রশস্ত্র, ধাতব শিল্পকর্ম, চীনা মাটি ও কাচের শিল্পকর্ম, পুতুল, বাদ্যযন্ত্র, বস্ত্র ও পোশাক, নকশি কাঁথা, কাঠের শিল্পকর্ম, পাণ্ডুলিপি ও দলিল, সমকালীন শিল্পকলা, জয়নুল আবেদিন গ্যালারি রয়েছে। আর চারটি গ্যালারি জুড়ে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম: বাঙালি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামে নানা নিদর্শন রয়েছে।
তৃতীয় তলায় রয়েছে বিশ্বসভ্যতা, পাশ্চাত্য শিল্পকলা, বিশ্বমনীষী, চায়নিজ কর্নার, সুইজারল্যান্ড কর্নার, ইরানি কর্নার ও কোরিয়ান কর্নার।
জাদুঘরে একাত্তরের যত নিদর্শন
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম: বাঙালি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামে জাদুঘরে চারটি প্রদর্শনকক্ষ রয়েছে। এসব কক্ষে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগের ও পরের বিচ্ছিন্ন কিছু স্মারক রয়েছে। তবে দেশভাগে পর, বিশেষ করে ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সালের নির্বাচন, ৬৬ সালের ছয় দফা, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের বহু দলিল, স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে।
জাদুঘরের ৩৭ নম্বর গ্যালারি ধরে ঢুকলেই দেয়ালে দেখা মিলবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত নানা সময়ের বিভিন্ন দুর্লভ অনেকগুলো আলোকচিত্র। কিছুটা সামনে এসে ৩৮ ও ৩৯ নম্বর প্রদর্শন কক্ষে এসে দেখা মিলবে মুক্তিযুদ্ধের নানা নিদর্শন, দুর্লভ সংগ্রহের।
এই কক্ষে বেশ কিছু আলোকচিত্রে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের পর ধ্বংস হওয়া ব্রিজের আলোকচিত্র, তাদের প্রশিক্ষণের চিত্র, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মাধ্যমে রাজাকারদের প্রশিক্ষণের চিত্র রয়েছে। সেই সঙ্গে আছে শিল্পী সুলতানুল ইসলামের ভাস্কর্য ‘স্বাধীনতার জন্য’।
কিছুটা হেঁটে সামনে এগোলে দেখা যাবে বায়ান্নর ভাষা শহীদ শফিউরের রক্তামাখা ব্লেজার, শার্ট, জুতো। রয়েছে বিভিন্ন পত্রিকার কাটিং, যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা প্রস্তাবের অনুলিপি, আগরতলা মামলার আসামিদের আলোকচিত্র, ৭০ সালে পাকিস্তানের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক পোস্টার ‘সোনার বাঙলা স্মশ্মান কেন?’, রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকারের শপথ নেওয়ার আলোকচিত্র।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চালানো বর্বরতার বেশ কিছু আলোকচিত্রেরও দেখা মিলবে জাদুঘরে। রয়েছে পাকিস্তানের কুখ্যাত জেনারেল টিক্কা খান, ইয়াহিয়া খান, রাও ফরমান আলীসহ ৪৭ সাল থেকে ৭১ পর্যন্ত সব সেনাপ্রধানের আলোকচিত্র, ভারতের আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের চিত্র, মুক্তাঞ্চলে তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ দেওয়ার চিত্র, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আদিবাসীদের আলোকচিত্র।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কলকাতায় বাংলাদেশের সমর্থনে অবস্থান নেওয়া শহীদ জহির রায়হান, পটুয়া কামরুল হাসানের আলোকচিত্র, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত এয়ারক্রাফটের ধ্বংসাবশেষ, পাকিস্তানি হানাদারদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত শহীদ মিনারের স্তম্ভ, তখনকার থ্রি নট থ্রি রাইফেল, ডামি রাইফেল, এলএমজি, রকেট লঞ্চারের অংশ, মুক্তিযুদ্ধে নিহত বেশ কিছু মানুষের মাথার খুলি, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নির্মিত কামানের ধ্বংসাবশেষ, ব্যবহৃত ব্যাগ, হানাদারদের অবস্থান শনাক্ত করা মানচিত্র ইত্যাদি রয়েছে প্রদর্শনীতে।
এছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আদলে গড়া একটি রেপ্লিকাও এখানে রয়েছে। রয়েছে সাড়া জাগানো ‘চরমপত্র’-এর কথক এম আর আখতার মুকুলের সেই চরমপত্রের একটি কপি, তার আলোকচিত্র, যুদ্ধকালীন ব্যবহৃত একটি রেডিও।
দুর্লভ স্মৃতি আর স্মারক
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের পরীক্ষার খাতা, কলম, জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের ব্যবহৃত একটি চন্দন কাঠের বাক্স দেখা যাবে জাদুঘরে।
রয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের এয়ারফোর্স ব্যাজ, ইউনিফরম, কলম। আরেক বীর শ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের ব্যবহৃত স্যান্ডো গেঞ্জি, অ্যাংকলেট, চশমা, মোজা, ব্যাগও দেখা যাবে।
মুক্তিযুদ্ধের ১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানের ছড়ি, সামরিক ক্যাপ, তার নেতৃত্বাধীন ‘জেড ফোর্সের’ প্রতীক, জেড ফোর্সের ব্যবহৃত প্যাডের দেখা মিলবে জাদুঘরে; নানা সময়ে ‘রাজনৈতিক কারণে’ কখনো এসব জিনিস সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আবার এনে রাখা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টর এবং ‘কে ফোর্সের’ কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, চেক বইয়ের মুড়ি, পদক এবং ব্যজ রয়েছে জাদুঘরে। রয়েছে ৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর কে এম শফিউল্লাহর মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত পোশাক, মনোগ্রাম এবং আলোকচিত্র। আট নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর ব্যবহৃত শার্ট, জায়নামাজও রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে একমাত্র খেতাবপ্রাপ্ত বিদেশি উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ওডারল্যান্ডের বীর প্রতীক সনদপত্র, টাই, আলোকচিত্রের দেখা মিলবে জাদুঘরে।
এছাড়া শহীদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার ব্যবহৃত টাই, চিঠি, পোস্টকার্ড, ঘড়ি বই; শহীদ বুদ্ধিজীবী জি সি দেবের বই; শহীদ আলতাফ মাহমুদের ডায়েরি, চশমা, টোবাকো, কলম; শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নিজ হাতে লেখা চিঠি, আলোকচিত্র; শহীদ বুদ্ধিজীবি সিরাজুল হক খানের ব্যবহৃত নোটবুক, আলোকচিত্র, সনদ, ঘড়ি, কলম, চশমা; শহীদ বুদ্ধিজীবী সৈয়দ নাজমুল হকের সনদ, চশমা, নেমপ্লেট ইত্যাদি দেখা যাবে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে যে চিঠি দিয়েছিলেন, ঐতিহাসিক সেই চিঠিও স্বযত্নে সংরক্ষিত আছে জাদুঘরে।
‘সংস্কার চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত’
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে এক নতুন দেশের জন্ম হয়। ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল বাংলাদেশের জাতিসত্তার ভিত্তি। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে জাদুঘরে। যে আত্মপরিচয় বাংলাদেশের মানুষ আবিষ্কার করেছিল প্রধানত ১৯৫২ সালে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
তারা বুঝেছিল তাদের আর যে পরিচয়ই থাকুক না কেন, বাঙালি পরিচয়টি ঢাকা পড়েছে দ্বি-জাতিতত্ত্বকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণের মধ্য দিয়ে। ক্রমেই তা উন্মোচিত হয়ে ওঠে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য, পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের জাতিগত নিপীড়ন ও শোষণের মধ্যে।
১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয় হলেও দু'মাস পার না হতেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক সরকারকে সরিয়ে দেয় নিজেদের কায়েমী স্বার্থ অব্যাহত রাখতে।
১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করে তারা পূর্ব পাকিস্তানকে ক্রমাগত শোষণ এবং বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি নষ্ট করার নতুন নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকে।
১৯৬২ সালে ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলন এবং ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলে স্বাধীনতা সংগ্রাম নতুন মাত্রা পায়।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা বাঙালির মুক্তির সনদ হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এতে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা শেখ মুজিবুর রহমানকে বার বার গ্রেপ্তার করে ৬ দফা আন্দোলনকে প্রতিহত করতে চেষ্টা করে। এতে সফল না হয়ে তারা তাকে ১ নম্বর আসামি করে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’ (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা) নামে মামলা দায়ের করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু তার ফল হয় উল্টো।
১৯৬৯ সালে ছাত্রদের ১১ দফা ভিত্তিক আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধায় ভূষিত হয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
ক্রমাগত গণঅসন্তোষের মুখে ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। আবার সামরিক আইন জারি হয়। তারপর ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। বাংলাদেশের পতাকাও উত্তোলিত হয়।
কিন্তু জনগণের গণতান্ত্রিক রায়কে অস্বীকার করা হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়ে বাঙালিদের জানিয়ে দেন যে সামরিক আঘাত আসা মাত্র শত্রুকে পাল্টা আঘাত করতে হবে। পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী শেষ আঘাত হানে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কাল রাতে।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী শুরু করে বাঙালি হত্যা। এমন নির্বিচার নিধনযজ্ঞ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ইহুদি নিধনের সঙ্গে তুলনীয়। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। জনগণ মহাপ্রতিরোধ গড়ে তোলে পাকিস্তানের হানাদার সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে এবং অবশেষে ছিনিয়ে আনে কাঙ্ক্ষিত বিজয়।
এই পটভূমিতে নানান নিদর্শন, স্মারক, ছবি ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম: বাঙালি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক চারটি প্রদর্শনী কক্ষে উপস্থাপিত হয়েছে।
তবে ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্যসব জায়গার মত জাদুঘর থেকেও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দেওয়ার ছবি, দেওয়ালে সাঁটানো পোস্টার, ব্যনার এবং তার স্মৃতিবিজড়িত জিনিসপত্র।
আগে সেখানে দুটি মনিটরে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হলেও এখন তা বন্ধ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে চারটি প্রদর্শনকক্ষ থাকলেও কোথাও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একক কোনো আলোকচিত্র নেই; নেই তার স্মৃতিচিহ্নও। ৪০ নম্বর গ্যালারিতে সংরক্ষিত ছিল বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত পাইপ, চশমা, খাট ইত্যাদি। এখন কক্ষটি পুরোপুরি ফাঁকা। পাশে পোস্টার সাঁটানো রয়েছে, “সংস্কার চলছে। সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত।”
গ্যালারি অ্যাটেন্ডেন্টদের একজন বললেন, ৫ অগাস্টের আগেও দেয়ালে শেখ মুজিবুর রহমানের আলোকচিত্রসহ বেশ কিছু চিত্র ছিল। ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতা প্রবেশ করে কিছু ছবি-ব্যনার নামিয়ে ফেলে। পরে বিভাগীয় কিপার বঙ্গবন্ধুর বাকি সব স্মৃতি চিহ্ন সরিয়ে ফেলেন।
এই গ্যালারি ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা বিভাগের অধীন। জানতে চাইলে বিভাগের কিপার মোহাম্মদ মনিরুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের কাছে তো অনেক নিদর্শন জমা আছে, তো আমাদের পরিকল্পনার একটা অংশ আছে কিছু নিদর্শন কিছুদিন পরপর পরিবর্তন করা। এক নিদর্শন বারবার দেখতে-দেখতে দর্শকরা তো ক্লান্ত হয়ে পড়েন, একঘেয়ে লাগে।
“অনেক নিদর্শন দেখবেন এখন পাবেন, আবার ছয় মাস পর পাবেন না। এটা আমাদের প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ারই একটা অংশ। এরকম অনেক আছে।”
এখানে এলে নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কে কতখানি জানতে পারবে, সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “যারা এখানে আসবে, তারা বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে পারবে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানতে পারবে, দৈনন্দিন জীবনের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কেও জানতে পারবে। আমাদের অতীত ইতিহাস, যেমন, মুদ্রা, ভাস্কর্য ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারবে।”
দায়িত্ব ‘আরো আছে’
জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক নাফরিজা শ্যামা নাফরিজা শ্যামা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের প্রদর্শনী করার যে জিনিসিপত্র আছে, তার ৯ শতাংশ মাত্র আমরা প্রদর্শন করতে পারি। এটার দুটো কারণ; একটা হচ্ছে জায়গা কম আমাদের। এজন্য একটা নতুন ভবন করার অনুমোদন অলরেডি পাস হয়ে আছে। নতুন একটা ভবন হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “আমাদের নতুন ট্রাস্টি বোর্ড হয়েছে। এই ট্রস্টি বোর্ড ইতোমধ্যে আমাদের প্রদর্শনীতে যাওয়ার মত যেসব জিনিস আছে, সেগুলোর তালিকা নিয়ে দুটো মিটিং করে ফেলেছে। পুরনো জিনিসপত্র বাদ দিয়ে নতুন-নতুন জিনিসপত্র কী করে রেগুলার দেখানো যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত হয়ে আছে। খুব অল্প সময়ে দেখতে পাবেন।”
তবে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সালেক খোকন মনে করেন, জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুধু সংরক্ষণ করে রাখাটাই মুখ্য ব্যাপার না, এর প্রচারও দরকার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমি সংরক্ষণ করে রাখলাম, কিন্তু প্রজন্মকে জানালাম না; স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীদের, তরুণ প্রজন্মকে নানা রকম কর্মসূচির মাধ্যমে যদি আনতে না পারা যায়, তাহলে কিন্তু আসল উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে না।”
তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাবিদার যারা ছিল, তারাও যে একাত্তর নিয়ে জাদুঘরকে অনেক বেশি সচল করতে পেরেছিল, আমি সেটা মনে করি না। মুক্তিযুদ্ধের অনেক কাজই হওয়া উচিত ছিল, যেটা হয়নি। হয়েছে কিছু তৈলাক্ত কাজ।
“এখনো আমরা গণহত্যার ইতিহাস তুলে আনতে পারিনি। যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের নামের তালিকা করতে পারিনি। শহীদদের অনেকের চিঠি আমরা এখনও পাই, কারও হয়ত রক্তাক্ত শার্টটা পাচ্ছি, বা অন্য নিদর্শন পাচ্ছি তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে। সেগুলোকে সংররক্ষণ করে, তাদের ইতিহাসকে তুলে ধরার কাজটা করা যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের যে জায়গাগুলো নিয়ে এখনো কাজ হয়নি, সেগুলো নিয়ে কাজ হওয়া উচিত।”