Published : 19 Oct 2024, 01:30 AM
মেট্রোরেল চালুর পর প্রথমবারের মত পরিবার নিয়ে বেড়াতে যান মনোয়ার হোসেন; সবার সঙ্গে বাচ্চার টিকেটও কাটেন, যদিও পরে সেটি কাজে না লাগায় নিজের কাছেই রেখে দেন। এতে তার কিছু যায় আসেনি; তবে তার মত আরও অনেকে টিকেট নিয়ে যাওয়ায় সংকটে পড়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ।
মিরপুরের পল্লবী স্টেশনে বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মনোয়ার বলেন, “দেখলাম বাচ্চাকে এমনি যেতে দিচ্ছে, তখন আর ওর কার্ডটা ইউজ করিনি। ভাবলাম পরে হয়ত আমরা ব্যবহার করতে পারব।
“তখন তো আর বুঝতাম না। পরে জানলাম কার্ড একটা নির্দিষ্ট সময় পর অকার্যকর হয়ে যায়। জরিমানার ভয়ে আর জমা দেওয়া হয়নি, এখন দিয়ে দেব।”
তার মত অনেক যাত্রীই নানা কারণে আর বিভিন্নভাবে মেট্রোরেলের একক যাত্রার টিকেট নিজের সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বলছে, সেসব টিকেটের সংখ্যা দুই লাখ, যেখানে মেট্রোরেলের একক যাত্রার টিকেটিই ছিল ৩ লাখ ১৩ হাজার। এর মধ্যে ১৩ হাজার টিকেট নষ্টও হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে এখন এক লাখের মত টিকেট রয়েছে তাদের কাছে।
বিপুল পরিমাণ এই টিকেট হারিয়ে যাওয়া বা যাত্রীরা নিয়ে যাওয়ার কারণে এখন টিকেট সংকট তৈরি হয়েছে। টিকেট কম থাকার কারণে অনেক ভেন্ডিং মেশিন থাকছে বন্ধ। লম্বা সময় টিকেটের অপেক্ষায় যাত্রীদের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।
মেট্রোরেলে দুই ধরনের টিকেট আছে। এমআরটি পাস কিনে শুধু রিচার্জ করে যাত্রীরা ট্রেনে চড়তে পারেন। যতক্ষণ কার্ডে টাকা থাকে ততক্ষণ ট্রেনে চড়া যায়। সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা রিচার্জের সুযোগ আছে।
এভাবে কার্ড করে চলাচলে ১০ শতাংশ ছাড়ও মেলে। এই কার্ড পাঞ্চ করে স্টেশন থেকে বের হতে হয়। পাঞ্চ মেশিনেই ভাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে নেওয়া হয়।
আর একক যাত্রার টিকেট কেটে গন্তব্যে যাওয়া যায়। এই একক যাত্রার টিকেট মেশিনে ঢুকিয়ে বের হতে হয়। এ টিকেট মেশিনে দিলেই শুধু স্টেশন থেকে বের হওয়ার সুযোগ থাকে।
তবে একজন টিকেট দেওয়ার পর তার সঙ্গে বের হয়ে যাওয়া যায়, এমন সুযোগই নিয়ে থাকেন টিকেট নিয়ে বের হতে চাওয়া যাত্রীরা।
‘মজা করেই’ নিয়ে গেছেন কেউ কেউ
মেট্রোরেলভিত্তিক বিভিন্ন ফেইসবুক গ্রুপে যাত্রীরা প্রায়ই ‘মজার ছলে’ বা ইচ্ছে করে টিকেট এভাবে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে পোস্টও করেছেন। কেউ কেউ ‘স্মৃতি হিসেবে’ টিকেট নিজের কাছে রেখে দেওয়ার কথা বলছেন।
তবে টিকেট নিয়ে এমন কর্মকাণ্ডে যাত্রী আর নিরাপত্তা কর্মীদের সচেতনতার অভাবের কথা বলছেন অন্য যাত্রীরা।
সংকটের পর যারা টিকেট নিয়ে গেছেন, তাদের সেগুলো ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এজন্য জরিমানা না করার ঘোষণা দিয়েছেন ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রউফ।
আয়েশা আক্তার নামে এক যাত্রী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একজন বের হওয়ার পর তার পেছনে পেছনে আরেকজন যাওয়ার সুযোগ থাকে। ওইরকম সিকিউরিটির কেউ থাকে না। আমারও সুযোগ ছিল টিকেট নিয়ে যাওয়ার, কিন্তু নিইনি।”
টিকেট নিজের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে পরে ফেইসবুকে বিষয়টি নিয়ে পোস্টকারীদের একজন শাকির মাহমুদ বলেন, গত দুই বছরে যাত্রা শেষে তিনি পাঁচটি টিকেট জমা দেননি।
“একজন বের হলে তার পেছনে পেছনে চলে যাওয়া যায়; কেউ দেখে না। সে কারণে মজা করে নিয়ে আসছি। আর আমি তো টিকেটের টাকা দিয়েছিই।”
মেট্রোরেল: একক যাত্রার আড়াই লাখ টিকেটের দুই লাখই নিয়ে গেছে যাত্রীরা
আগারগাঁও মেট্রো স্টেশনে টিকেট জমা দেওয়ার মেশিনের দায়িত্বে থাকা এক নারী নিরাপত্তা কর্মী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একেক জায়গায় তিনটি করে পিজির (কার্ড জমা দেওয়ার জায়গা) বিপরীতে কেবল একজন নিরাপত্তা কর্মী থাকে। ফলে তার একার পক্ষে সবার দিকে নজর রাখা সম্ভব হয় না।
“সেই ফাঁকে লোকজন টিকেট নিয়ে চলে যায়। আর একজনের পেছনে আরেকজন যাত্রী চলে যায়। ভিড় যখন বেশি হয়, তখনই এমনটা হয়।”
নাম প্রকাশ না করে পল্লবী মেট্রো স্টেশনের একজন টিকেট মেশিন অপারেটর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোথাও যাওয়ার সময় যাত্রীরা একাধিক টিকেট কাটে; তখন তাদের কাছে টিকেট থেকে যায়।
“আমার পক্ষে তো বিচার করা সম্ভব না, তার সঙ্গে কতজন আছে। আবার একটা টিকেটের দাম পড়ল ৮০ টাকা; এখন সে ২০ টাকা ভাংতি পাচ্ছে না মেশিনে। তখন ২০ টাকার আরেকটা টিকেট কেটে নিয়ে চলে যায়। কিন্তু কার্ডটা তো পরে আর ব্যবহার করা যায় না, স্মৃতিস্বরূপ রেখে দেয়। প্রথম দিকে এরকম অনেকে নিয়ে গেছে।”
এর পেছনে মেট্রোরেলের লোকবল সংকটকেও কারণ বলে মনে করে তিনি।
তার ভাষ্য, “সিকিউরিটিতে একজন থাকে তো, ভিড়ের সময় অনেকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়; কার্ডটা সাথে থেকে যায় তখন। অনেক সময় বাচ্চাদের টিকিট কাটে, কিন্তু পরে যখন দেখে তার টিকেটটা লাগছে না, তখন আর সেটা জমা দেয় না।”
পল্লবী মেট্রো স্টেশনের টিকেট জমা দেওয়ার মেশিনের দায়িত্বে থাকা এক কর্মী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেকে এমন করে যে আজকে টিকেট বেশি কাটছে পরেরদিন ব্যবহার করার জন্য। কিন্তু দেখা যাচ্ছে পরেরদিন আর সেটা কাজ করছে না।
“আমাদের সামনে ধরা পরছে, কার্ড কাজ করছে না। তখন বলে, কালকে কেটে রাখছিলাম আজকে যাওয়ার জন্য। তখন জমা দিয়ে দিতে বলি।”
কিছু যাত্রীর পরে এসে টিকেট জমা দেওয়ার তথ্যও দেন তিনি।
“অনেকে বলে এখানে কুড়িয়ে পেয়েছি। তাদের কোনো ধরনের জরিমানা করা হয়নি। আমরা আমাদের চোখের সামনে দিয়ে কার্ড নিয়ে চলে যেতে দেই না।”
আগারগাঁও স্টেশনের টিকেট মেশিন অপারেটর ইয়াসমিন আক্তার বলেন, “বের হওয়ার সময় অনেক যাত্রী টিকেট সঙ্গে করে নিয়ে যায়; কেউ অসচেতনতার কারণে; আবার অনেকে টিকেট রেখে যেতে হবে, সেটা না জেনেই নিয়ে যায়।”
তিনি বলেন, “আবার অনেকে বেশি টিকেট কাটে, কিন্তু সঙ্গে যে যাবে সে আসে না কিংবা বাসায় চলে যায়; তখন আর জমা দেয় না। ভাবে যে, এটা এখন তার টিকেট হয়ে গেছে। কিন্তু সে তো ভাড়া দিয়েছে, টিকেটের মূল্য তো আর দেয়নি।”
বড় হচ্ছে লাইন, বাড়ছে অপেক্ষা
একক যাত্রার টিকেট সংকটের কারণে এখন মেট্রো স্টেশনগুলোতে যাত্রীদের বেশি সময় টিকেটের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে লম্বা লাইনে। কেউ টিকেট না পেয়ে ফিরেও যাচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোচিং করতে নিয়মিত মেট্রোরেলের পল্লবী স্টেশন থেকে ফার্মগেইটে আসা-যাওয়া করেন আব্দুল্লাহ আল সাদ। বুধবার সকাল পৌনে ৮টা থেকে ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করেও টিকেট পাননি তিনি।
সাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে ছিলাম; টাকা ফেরত দিয়ে দেয়, টিকেট আসে না। এখন প্রায়ই হয় এমনটা, পিক আওয়ারে বেশি সাফার করতে হয়।
“ক্লাসে সময়মত যেতে পারছি না। ডাক্তারের সিরিয়ালও মিস হইছে। চার দিন আগে টিকেটের জন্য ২০ মিনিট ধরে অপেক্ষা করতে হইছে, যেতে যেতে সিরিয়াল শেষ। পরে আব্বার কাজ থাকায় চলে আসতে হইছে, ওইদিন আর ডাক্তার দেখাতে পারিনি।”
নাম প্রকাশ না করা পল্লবী মেট্রো স্টেশনের সেই টিকেট মেশিন অপারেটর বলেন, টিকেট সংকটের কারণে তারা সবগুলো কাউন্টার এক সঙ্গে খোলা রাখতে পারছেন না। ফলে লাইন বড় হওয়ার পাশাপাশি যাত্রীদের সময় নষ্ট হচ্ছে।
“যে কার্ডগুলো জমা হচ্ছে সেগুলো সঙ্গে সঙ্গে বের করে আমরা চালাচ্ছি। এমনও হয় যাত্রীরা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু টিকেট নাই। আবার জমা হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয় তখন।”
তিনি বলেন, “যাত্রীদের সমস্যা হচ্ছে। আগে যে সময় অপেক্ষা করতে হত, এখন তার চেয়ে ১৫/২০ মিনিট বেশি অপেক্ষা করতে হয় অনেক সময়।”
আগারগাঁও স্টেশনের টিকেট মেশিন অপারেটর ইয়াসমিন আক্তার বলেন, “এখন মেট্রোরেলের প্রতিটি স্টেশনেই টিকেটের সংকট রয়েছে। পিজি থেকে সাথে সাথে ৫০/১০০টা কার্ড খুলে নিয়ে আসতে হয়। প্রতিটা পিজিতে দুইটা করে বক্স থাকে, প্রতি বক্সে ৬১৩টা করে কার্ড ধরে। আগে যখন পরিপূর্ণ হত, তখন আমরা বের করতাম। আর এখন কার্ড শর্ট থাকছে।”
গত এক সপ্তাহ ধরে এমন সমস্যা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
কী বলছে কর্তৃপক্ষ
একক যাত্রার টিকেট সংকটের কারণে আরও টিকেট কেনার কথা বলছেন ডিএমটিসিএলের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইন্টেন্যান্স) নাসির উদ্দিন আহমেদ।
বাড়তি নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগের এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “নিরাপত্তা তো আছেই, প্রতিটা মেশিনে (পিজি) একজন করে নিরাপত্তা কর্মী দিলে দুই শিফটে লাগবে কত? তাহলে তো ওদের বেতনেই যা টাকা ইনকাম হয় চলে যাবে।”
টিকেট সংকটে আরও ২০ হাজার টিকেট কেনার কথা জানিয়েছেন ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রউফও।
একেকটা টিকেট কিনতে দেড়শ টাকার কাছাকাছি খরচ পড়ে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের টিকেট আসতেছে, ১৮ তারিখে (শুক্রবার) ফ্লাইটে ওঠার কথা।
“২০ হাজার টিকেট আনা হচ্ছে। জাপানের সনির তৈরি টিকেটগুলো থাইল্যান্ডে প্রসেস হয়ে সবশেষ ভারতে চেকিং হয়ে আসছে।”
অপরদিকে একক যাত্রার এ টিকেট পদ্ধতি পরিবর্তনের কথাও বলেছেন এই কর্মকর্তা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এই সিস্টেমটাই রাখতে চাচ্ছি না, সেখানে আরও আধুনিক সিস্টেম চালুর চেষ্টা করছি।
“যেমন- কিউআর কোড হতে পারে, কয়েন সিস্টেম হতে পারে। আমাদের সিস্টেমও আরও মডিফাই করার চেষ্টা করছি, কীভাবে এটাকে আরও আপডেট করা যায়। আমাদের এখান থেকে যাতে র্যাপিড পাস বিক্রি করা যায়, সেটার ওপরও কাজ করা হচ্ছে।”
আবদুর রউফ বলেন, “টিকেট জমা দেওয়ার মেশিনে নিরাপত্তা বাড়াতে আরও কর্মী নিয়োগের কাজ করছে কর্তৃপক্ষ, ২০৩ জন লোক নেওয়া হবে।
“প্রতিটা মেশিনে আসলে কর্মী রাখা যায় না। একেকজনকে বেতন দিতে হবে না? যেখানে একজন, সেখানে দুইজন যাতে থাকে তা নিশ্চিত করা হবে।”