‘আমার বউডা যে বাইচ্চা আছে, এইডাই অনেক’

ঈদ শেষে পরিবারের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জে ফিরছিলেন জহুরা, চলন্ত লঞ্চ থেকে নদীতে পড়ে যাওয়ার ১০ ঘণ্টা পর উদ্ধার হয়েছেন- জীবিত অবস্থায়।

শাহরিয়ার নোবেলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 May 2023, 05:01 PM
Updated : 5 May 2023, 05:01 PM

“নদীর মাইঝে সারারাইত ঠ্যাঙ ভাঙা লইয়া আমার বউ যে বাইচ্চা আছে- এইডাই অনেক। হাজার হাজার শুকরিয়া। আমি তারে আর কিচ্ছু জিগাই নাই। আল্লায় রাখছে তারে, আমার কিচ্ছু জানার দরকার নাই।”

চলন্ত লঞ্চ থেকে নদীতে পড়ে নিখোঁজের ১০ ঘণ্টা পর স্ত্রী জহুরা বেগমকে জীবিত অবস্থায় পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বলছিলেন জহুরুল ইসলাম। শুক্রবার দুপুরে তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে।

ঈদ শেষে শরীয়তপুরের গোসাইরহাট থেকে ঈগল-৩ লঞ্চে চড়ে নারায়ণগঞ্জ আসার পথে বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঠাণ্ডারবাজার এলাকায় নদীতে পড়ে যান জহুরা।

ঘটনার বর্ণনায় স্বামী জহুরুল বলছিলেন, “আমি আমার বউ আর ছেলে কেবিনে। সে ইকটু পান খাইছিলো। আমারে কইলো, ‘পানি দেও, কুলি করমু।’ এই কথা কইয়া বাইরে বারিন্দায় গেছে পরেই, জর্দা বেশি আছিল মনে হয়, এই মাথা ঘুইরা নাকি ক্যামনেই জানি হেয় নদীতে পইড়া গেলো।”

স্ত্রীর পড়ে যাওয়ার বিষয়টি টের পেয়ে বাইরে এসে নিজের বোধ হারিয়ে ফেলেছিলেন বলে জানালেন জহুরুল।

“এইরম যে হইবো এইডা তো কোনোদিন চিন্তাও করি নাই। আমার বউ নদীতে পইড়া গেছে ভাই আমি কী করুম? কেবিনে পোলার কাছে মোবাইল দিয়া, বয়া লইয়া আমিও ঝাঁপ দিছি। হেরে তো পাই না। খুঁজি পাই না, পাই না। একসময় হের জুতাডি পাইছি। আমার বউ পাই না ভাই, জুতা দিয়া কী করুম?”

বয়া নিয়ে স্ত্রীকে কতক্ষণ খুঁজেছেন তা মনে করতে পারলেন না জহুরুল। বয়া নিয়ে ভেসে ছিলেন নদীতে। একপর্যায়ে লঞ্চের আলোতে তাকে দেখতে পেয়ে কিছু জেলে তাকে নৌকায় তুলে নেয়।

জহুরুল বলেন, “হেয় পড়ছে, আর আমি তো পোলারে রাইখ্যা লাফ দিছি। আমার বউ নদীতে, পোলা লঞ্চে, আমি কী করুম ভাই, খালি আল্লাহরে ডাকছি। লঞ্চও ব্যাক দিয়া তাগো লাইট দিয়া ঘণ্টাখানেক খুঁজছে। জাইল্লারা খুঁজছে, পায় নাই।”

স্ত্রীকে খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা জহুরুল জেলেদের সহায়তায় ফোন দেন জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ। ছেলে তখনও লঞ্চে জানিয়ে জহুরুল বললেন, “আমি জাইল্লাগোরে কইলাম- লঞ্চে আমার পোলায় আছে, তারে আমার কাছে আইনা দ্যান। লঞ্চের লোকেরা কয়, ‘আমরা তো খুঁজলাম অনেক, লঞ্চে যাত্রীও আছে, পাইলাম না। মালপাতিগুলা রাইখা দেন, কোনো দরকার পড়লে আমাগোরে জানাইয়েন।’

“এই কইয়া তারা পোলারে আমার কাছে দিয়া চইলা গেলো। এতক্ষণে জাইল্লারা না জাল ফালাইছে না নদীতে, হ্যারাও জাল টানতে যাইবোগা।”

জহুরুল এই কথা যখন বলছিলেন, তখন গোঙানির সুরে স্বামীর কাছে পানি চাইছিলেন জহুরা। স্ত্রীর মুখে পানি তুলে দিয়ে জহুরুল আবার বলতে শুরু করেন, “ওগো নৌকায় যে কতক্ষণ আছিলাম কইতে পারি না। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে কোস্টগার্ড আইসা আমারে ফোন দিছে। পরে তারা স্প্রিটবোট (স্পিডবোট) লইয়া নদীর কূলে কূলে খুঁজছে, তাও তারে নদীর মধ্যে পাইলাম না।”

সারারাত খোঁজাখুঁজির পর বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জহুরাকে জীবিত উদ্ধার করা হয় বলে জানিয়েছে কোস্ট গার্ড। সেদিন দুপুর ২টার দিকে তাকে নেওয়া হয় ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেদিনই রাত ৮টার দিকে তার পায়ে অস্ত্রোপচার করা হয়।

অস্ত্রোপচার শেষে জোহরাকে হাসপাতালের নারী রোগীদের জিএইচও ওয়ার্ডের ২৬ নম্বর শয্যা দেওয়া হলেও ওই শয্যায় অন্য রোগী থাকায় জহুরা এখন আছেন ক্যাজুয়ালটি এক নম্বর ওয়ার্ডের করিডোরে, এক্সটেনশন থ্রি বেডে। সেখানে ফ্যান না থাকায় আছেন দুর্ভোগে।

শুক্রবার দুপুরে যখন জহুরুলের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন ব্যাথায় কাতরাচ্ছিলেন বেঁচে ফেরা জহুরা। ফিরে ফিরে জ্বর আসছে, ঘটনার আতঙ্কের ঘোর কাটেনি। অনেকটা গোঙানির সুরে স্বামীর কাছে বারবার পানি খেতে চাইছেন। স্বামী জহুরুল তার মুখে স্যালাইন আর পানি তুলে দিচ্ছেন, মাথায় দিচ্ছেন জলপট্টি।

জহুরুল জানালেন, নারায়ণগঞ্জে তার ক্ষুদ্র ব্যবসা রয়েছে; সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন সেখানেই। ঘটনার দিন ঈগল-৩ লঞ্চে করে গ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জে ফিরছিলেন।

নদীতে পড়ে যাওয়ার প্রায় ১০ ঘণ্টা পর জীবিত উদ্ধার হওয়াকে অনেকে ‘অলৌকিক’ বলে বর্ণনা করছেন। তাকে উদ্ধারের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন কোস্ট গার্ড সদস্যরাও।

সেই কথা বলতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন জহুরুল। বললেন, “অনেকটা সময় খোঁজার পরে ভাই এত বড় নদীতে আমরা তো পাই না তারে। কোস্ট গার্ডের লোকেরা বললো, ‘কী আর করবেন ভাই, এই রাতে আর তারে আমরা খুঁইজা পামু না। মনে হয় তলাই গেছে। সকালে খুঁজতে হবে।’

“এইটা বলার পরে আমি তখন ওইখানে কতক্ষণ কান্নাকাটি করলাম। এরপরে তারা আমারে জাইল্লাগো নৌকায় আইসা নামাইয়া দিছে। এতটুক মনে আছে।”

জেলেদের নৌকা করে কূলে উঠে কান্নাকাটি করে জ্ঞান হারান জহুরুল। সকালে শোনেন তার স্ত্রী বেঁচে আছেন, তাকে উদ্ধার করা হয়েছে।

জহুরুলের কথায়, “এইগুলার ভিতরে কি আর মনে থাকে! ৭টা-৮টার মধ্যে মনে হয় তারে পাইছে। পাইছে নাকি জাইল্লারা। স্রোতে ভাটির টানে আরও পিছনে ঠাণ্ডাবাজারের কাছাকাছি দিকে আইয়া চরে কিনারের ধারে ভিড়ছে, পরে সাড়ে ৭টার দিকে নাকি জাইল্লারা টাইন্যা তুলছে, তারাই কোস্ট গার্ডের কাছে দিছে।

“তখন তো মনে করেন সে অনেক অসুস্থ। ক্যামনে আছিল, ক্যামনে বাঁচছে, কিছু কইতে পারে নাই। কইলেও কোস্ট গার্ডের কাছে কইছে। আমি কান্নাকাটি করি- দেইখ্যা আমারে তো কাছে যাইতে দেয় নাই।”

উদ্ধারের পর প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য জহুরা বেগমকে নিয়ে যাওয়া হয় গোসাইরহাট। সেখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা আনা হয়।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসার পর জহুরাকে দেখেছেন এমন এক হাসপাতাল কর্মীর সাথে কথা হল।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বললেন, “এটা একটা অলৌকিক ঘটনা। উনার এক পায়ে দুই ভাঙ্গা। যে ক্ষত হয়েছে, তা নিয়ে এই ৯-১০ ঘণ্টা নদীর মধ্যে কীভাবে উনি বেঁচে ছিলেন, তা একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা। তার ক্ষতে যে রক্তক্ষরণ হয়েছে, তাতে এতক্ষণে বড় কিছু হয়ে যেতে পারত। তাকে আনার পর এক ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে।”

কোস্ট গার্ডের ঢাকা জোনের জোনাল কমান্ডার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটমকে বলেন, ৯৯৯ এর মাধ্যমে জানতে পেরে তারা চাঁদপুরে খবর দেন। চাঁদপুর স্টেশানের আওতায় হাইমচর এলাকায় কোস্ট গার্ডের একটি আউটপোস্ট আছে, তারা এ অভিযান চালায়।

কোস্ট গার্ডের চাঁদপুর স্টেশনের কমান্ডার লে. মাশহাদ উদ্দীন নাহিয়ান বলেন, “স্টেশান ইনচার্জ হিসেবে আমি রাত সাড়ে ১২টার মধ্যে আমার টিমকে রেডি করি এবং আমার টিম দেড়টার মধ্যেই বের হওয়া শুরু করে। আমরা টাইট ক্যালকুলেশন করে একটা কো-অর্ডিনেট ঠিক করি যে- নারী পড়ে গেছেন, তিনি কোন এরিয়াতে থাকতে পারেন, তা ঠিক করি।

“দুইটা বোট নিয়ে আমরা যাই। এর মাঝে বড় বোটটা মেঘনা মেইন চ্যানেলে সার্চ করতে থাকে। আর ছোট একটা স্টিল বোট ভাড়া করে আমাদের এক টিম ভেতরে পাঠাই। ওরাই সকালের দিকে জহুরা বেগমকে খুঁজে পায়।”

জহুরাকে উদ্ধারের পরের পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “তিনি তখন ভীষণ আঘাতপ্রাপ্ত ও ট্রমার মধ্যে ছিলেন। তাকে উদ্ধারের পর তার যে ইনজুরি, তাতে আমাদের মেডিকেল স্টাফ দ্রুত ফার্স্ট এইড দিয়ে ফ্যামিলির কাছে দিয়ে উনাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আগে হাসপাতালে পাঠাই। এটাই তখন জরুরি ছিল।”

মাশহাদ উদ্দীন নাহিয়ান এই নারীকে উদ্ধারের বেশির ভাগ কৃতিত্ব দিলেন স্থানীয়দের।

“ওখানকার এলাকার মানুষ আমাদের অনেক হেল্প করেছে। তাদের সাথে নিয়েই আমরা খুঁজেছি। যে জেলেরা ছিল- ওদের একজন বলেছে, এমন কিছু একটা দেখেছি। আমরা সকালের দিকে তাদের কথা শুনে যাই এবং তাকে আমাদের লোক এবং গ্রামের লোক টেনে নৌকায় তোলে। আমি গ্রামের লোকদের ক্রেডিট দেব, দে হেল্পড আ লট। আমরা সেখানে একটা ক্যাটালিস্ট হিসেবে ছিলাম।”

অদম্য প্রাণশক্তি নিয়ে জীবন বাঁচাতে দীর্ঘসময় নদীতে ভেসে থাকলেও উদ্ধারের পর আতঙ্কের ঘোর কাটছে না জহুরার। খানিক পরপরই তার শরীর কেঁপে উঠছে।

স্ত্রীর এই বেঁচে ফেরাকে স্বামী জহুরুল কী বলবেন, সেই ‘ভাষা’ তার নেই।

“কী কইরা ছিল, ক্যামনে ছিল- হেয় জানে, আর আল্লায় জানে। আমি গিয়া দেখছি কোস্ট গার্ডের বোটের ভিতরে। তহন আর কিচ্ছু জিগাই নাই, আমার বউ বাইচ্চা আছে- এইডাই আলহামদুলিল্লাহ।”

হাসপাতালে মেয়ে জহুরার সেবায় এসেছেন তার মা। তিনি বললেন, “আমার সন্তান যে ফিইর‍্যা আইছে, এইডাই লাখ লাখ শুকরিয়া, আমারে কিছু জিগাইয়েন না।”