“এরশাদ সরকারের পতনের পর দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ফিরে আসলেও সামরিক বাহিনীর রাজনীতিকরণ পুরোপুরি থেমে যায়নি।”
Published : 05 Oct 2024, 10:11 PM
সামরিক বাহিনীতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে ‘সামরিক আইন সংস্কার কমিশন’ গঠনের দাবি জানিয়েছেন সশস্ত্র বাহিনীর একদল অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা।
আওয়ামী লীগ আমলে সেনাবাহিনী থেকে রাজনৈতিক কারণে যাদের বরখাস্ত ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, তাদের মধ্যে যাদের বয়স আছে তাদেরকে চাকরিতে পুনর্বাসন ও যাদের বয়স শেষ তাদেরকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন তারা।
শনিবার ঢাকার মহাখালীর রাওয়া কমপ্লেক্সে সশস্ত্র বাহিনীর প্রাক্তন কর্মকর্তাদের আয়োজনে 'বৈষম্যমুক্ত সশস্ত্র বাহিনী- বাংলাদেশ ২.০ বিনির্মাণে প্রয়োজনীয় রূপরেখা' বিষয়ে এক সেমিনারে এসব দাবি জানানো হয়।
আয়োজকরা নিজেদেরকে ১৫ বছরে ‘রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার' বলে দাবি করেন।
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান নাসিরের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অবসরপ্রাপ্ত কমান্ডার নেছার আহমেদ জুলিয়াস।
তিনি বলেন, “ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে সশস্ত্র বাহিনীর নিরপেক্ষতা ও পেশাদারত্ব বারবার বিঘ্নিত হয়েছে। এর ফলে সামরিক আইন ও নিয়মের অপব্যবহার হয়েছে। বাহিনীর মেধাবী কর্মকর্তাদের অযৌক্তিকভাবে সামরিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত করে বিনা পেনশনে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।”
১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুথুানের পরে সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রধান হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, “জেনারেল জিয়া তার নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেন।
“১৯৮২ সালে জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করে সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক শাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসেন। পরে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ফিরে আসলেও সামরিক বাহিনীর রাজনীতিকরণ পুরোপুরি থেমে যায়নি।”
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠে বলেও অভিযোগ করা হয় মূল প্রবন্ধে।
নির্যাতন ও চাকরিচ্যুত হওয়ার অভিযোগ তুলে ধরে সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান বলেন, “আমাকে ২০১১ সালে কর্মস্থল থেকে আমাকে গুম করা হয়। ৪৩ দিন হাত-পা ও চোখ বেঁধে রাখা হয়।
“যতবড় অপরাধী করি, আপনি আমাকে গুম করতে পারেন না। আপনারা আমাকে গুম করলেন। তারপর সাত মাস ১০ দিন আটকে রেখে কোট মার্শাল করলেন। মুঠোফোনের কথোপকথনের হাতে লিখে সেটার ভিত্তিতে বিচার করলেন।”
আওয়ামী লীগের পতনের পর চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানের সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে তাকে গুম, নির্যাতন ও চাকরিচ্যুত করা হয় বলেও অভিযোগ করেন হাসিনুর।
‘যারা ক্ষমতায় তাদের আর বিশ্বাস করতে চাই না’
আলোচনায় অংশ নেন সরকার পতন আন্দোলনের ডাক দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিদ আলমও।
দুই ছাত্রনেতা অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ আনেন।
সংবিধান বাতিলের দাবি জানিয়ে হাসনাত বলেন, “এ সরকার হয়ত ভুলে গিয়েছে, তারা বিপ্লবী সরকার। আমরা তাদের পদক্ষেপের মধ্যে এখনও এই জিনিসটি বুঝতেই পারি না বা তারা নিজেরাই বুঝতে পারে না, তারা একটি বিপ্লবী সরকার।
“এ সরকারে যারা রয়েছেন তাদেরকে অনুধাবন করতে হবে এ সরকার কোনো সংবিধান-নিয়ম মেনে আসেনি। সুতরাং সংবিধানের কোনো নিয়মের দোহাই দিলে তারা পুরো জাতিকে আবার হতাশ করবে।”
ক্ষমতাচ্যুত সরকারে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে ‘সুশীলতা’ দেখানোর অভিযোগ এনে সারজিস বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কিংবা অন্যরা উপদেষ্টা হয়েছেন হাজার হাজার জীবনের রক্তের উপর। অর্ধলক্ষ ভাই বোন রক্ত দিয়েছে, এখনও অনেকে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। রক্তের দাগ এখনও শুকায় নাই। আপনারা যদি ওই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে বসে এই সুশীলতা দেখান, সেটা দেখতে আমরা প্রস্তুত নই।
“আপনারা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন।”
যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে সারজিস বলেন, “যদি তারা না করতে পারে, তাহলে যে রক্তের উপর দাঁড়িয়ে তারা ওই আসনগুলোতে বসেছে সেই রক্তের মর্যাদা তারা নিজেরা নষ্ট করছে।”
সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, অবসরপ্রাপ্ত কমান্ডার মোহাম্মদ শাহরিয়ার আকন্দ, অবসরপ্রাপ্ত মেজর আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন হেফাজ উদ্দিন, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট সাইফুল্লাহ খানও সেমিনারে বক্তব্য রাখেন।