“টাকা দিলে করে দিতে পারে, সেটা সরকার কেন পারবে না?” বলেন তিনি।
Published : 16 Feb 2025, 04:40 PM
দেশের বিভিন্ন খাত ডিজিটাইজ করা হলেও নাগরিকদের ভোগান্তি যে পুরোপুরি লাঘব হয়নি, সেই বাস্তবতা মাথায় রেখে মাঠ প্রশাসনকে কাজ করতে বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
ডিসি সম্মেলনে তিনি বলেছেন, “শেষ বয়সে কোথাও কোথাও যেতে... একটা পাসপোর্ট দরকার। পাসপোর্ট করা হয়নি জন্ম নিবন্ধন নেই বলে, জন্ম নিবন্ধন লাগবে, আমার আমলে জন্ম নিবন্ধন কে করত জানিও না ইত্যাদি। কিন্তু পাওয়া যায়- পয়সা দিলে ঠিকই চলে আসে; পয়সা দিলে যখন ঠিকই চলে আসে- তাহলে পয়সা না দিলেও আসার কথা।
“এই সিস্টেমটা আমরা করতে পারছি না কেন? এটা তো একজন নাগরিকের অবশ্য প্রাপ্য- আমার জন্মসনদ। সরকার ব্যবস্থা করতে পারেনি, এই বলে অজুহাত দিয়ে তো চলবে না। নিশ্চয়ই ব্যবস্থা আছে- কিছু একটা করতে হবে।”
রোববার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলে তিন দিনের ডিসি সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছিলেন ইউনূস।
তার কথায়, “ওই যে বললাম যে- টাকা দিলে করে দিতে পারে, সেটা সরকার কেন পারবে না? কাজেই আমাদের সেই ব্যবস্থা করতে হবে; জন্মসনদ তার প্রাপ্য- যেকোনো সময়, যে বয়সেই চায়- তাকে দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
“কী করতে হবে? ওই যে বললাম সৃজনশীল হতে হবে। এটা থেকে নিয়ম বের করতে হবে; কারণ ওইটার উপরে সমস্ত কিছু নির্ভর; সেই জন্মসনদ জন্মসূত্রে আমি বাংলাদেশি- এটার একটা প্রমাণ, দালিলিক প্রমাণ- এই দলিল দিয়ে আমি ভবিষ্যতে যা কিছু করি…।”
নাগরিক সেবাকে কীভাবে পুরোপুরি অনলাইনভিত্তিক করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে সরকারপ্রধান বলেন, “ওইটা (জন্মসনদ) না হলে এনআইডি পাওয়া যাচ্ছে না, এনআইডি না হলে পাসপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে না, সব আটকে গেল- সবকিছু। আমি বলছি যে- এটা সবার একইসঙ্গে তার সমস্ত কিছু হতে হবে, যদি আমার জন্মসনদ থেকে থাকে, তাহলে আমি এনআইডি পাব।
“এখন অনলাইনে পাওয়ার কথা- আমরা অনলাইনে পাচ্ছি কি না, অনলাইনে এখন ই-পাসপোর্ট হচ্ছে কি না, এখনো দেখি ওই এমআরপি এমআরপি করছে। কেন হচ্ছে না? আইন তো আছে, আমি বলছি রাতারাতি সব হয়ে গেছে- এটাও আমি আশা করি না; শুরু তো করতে হবে।”
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “সে কাজটা করা যে- আমার এখানে, আমার জেলাতে এমআরপি আর হবে না, এখানে সব ই-পাসপোর্টে নিয়ে যাব আমি। যেহেতু এটা আমাদের এই টিমের কাজ, যেই টিম এখানে আমরা বসে আছি; এখানে আইন বানানো হয়, এটা আইন খাটানো হয়; নিয়ম মানা হয়- এগুলোতে আমরা কীভাবে যাব, একটা থেকে একটা আমরা উত্তরণ কীভাবে করব।
“বলছে যে, এখন জমি রেজিস্ট্রার করতে পারছে না- অমুক করতে পারছে না, কর দিতে পারছে না। এখানে আমরা শুনছি যে- সব অনলাইনের ব্যবস্থা হয়ে গেছে, হয়েই যদি যায়- সেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে না? কিসে আটকে গেলাম? কেন এখনো জমির রেকর্ডপত্র আমরা অনলাইনে পাই না, করতে পারি না? জমি বেচা-কেনা আমরা করতে পারছি না।”
সবকিছু ডিজিটাল হওয়ার কথা বলা হলেও প্রান্তিক পর্যায়ের চিত্র যে তা নয় সেটিই জেলা প্রশাসকদের মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “ভূমি মন্ত্রণালয় বলছে যে- আমরা সব করে ফেলছি, কিন্তু ইমপ্লিমেন্ট করতে পারছি না; ধীরে সুস্থ হচ্ছে না, কেন করছি না- এটাই হলো আমাদের অপারগতা।
“খেলোয়াড় হিসেবে আমরা সেই কাজটা করতে পারছি না, সেই খেলোয়াড়ের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে যে… অনলাইন মানে অনলাইন; আর কিচ্ছু থাকবে না। সেটা বলে কি রাতারাতি করতে পারব? না, রাতারাতি হবে না তো- সেটা আমি বলি নাই; কিন্তু এক জেলা ফার্স্ট হবে- সেটার কথা বলছি।”
নাগরিক সেবাকে দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে ডিসিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চান মুহাম্মদ ইউনূস।
“অনলাইনের জন্য এক জেলা ফার্স্ট হবে, ‘আমি সবটা করে ফেলেছি অথবা আমি ই-পাসপোর্ট করে ফেলেছি, এটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট আমার, আমি জমির যত কাজ আছে সব অনলাইন করে ফেলেছি, ফার্স্ট হয়েছি আমি’- এটা তো হতে পারে। আমি সেকেন্ড হতে পারি, থার্ড হতে পারি, আমি লাস্ট হতে পারি; হবে না- সে কথা ঠিক না।”
মানব সেবায় যে আনন্দ রয়েছে, সেই তৃপ্তি খোঁজার আহ্বান জানিয়ে ইউনূস বলেন, “এই বয়সে আমি দেশের এই টিমের, গভর্মেন্ট সরকারের টিমে যুক্ত হয়ে কী কাজটা সমাধান করে দিলাম, আমার কন্ট্রিবিউশনটা কী?
“একটা হলো যে ঠিক আছে- আমি করে ফেলেছি, তাদের বুঝ দেওয়া দরকার, বুঝ দিয়ে দিয়েছি- সেটা এক জিনিস। আরেকটা হলো যে- আমি কী করেছি? বুঝ দেওয়ার বাইরে যেটা আমার থেকে হোক…এখানে কারো রক্তচক্ষুর কারণে, কারো ধমকের কারণে কোনো কাজ করার প্রয়োজন নাই- অন্তত এই সময়টুকুতে; আমি নিজের মত করে যেটা আইন, যেটা দেশের জন্য করা দরকার, সেটা আমি করব; সেই কাজেই আমি ব্যস্ত থাকব- যাতে আমি করতে পারি।”
ছোট ছোট কাজের মাধ্যমেই সমাজের বড় সংকটের সমাধান করা যায় মন্তব্য করে ইউনূস বলেন, “শিক্ষা, শিক্ষার ব্যাপারে বহু স্তর আছে, আমি ওর মধ্যে যাব না। শুধু তোমাদের কাছে এটুকু বলার- প্রাথমিক শিক্ষা, একটু গিয়ে দেখা- কী করা যায় এটাকে। ...একটু দেখা দিলে, স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বললে- অনেক অনিয়ম-বেনিয়ম আছে- সেগুলো তো আছেই, তার মধ্যেও যদি একটি নিয়ম সৃষ্টি করা যায়; একজন জেলা প্রশাসক বললে তা সৃষ্টি করা যায়, তার সেই ক্ষমতা আছে। শুধু একটু নজর দেওয়ার ব্যাপার।
“সারা দেশজুড়ে অসংখ্য প্রাইমারি স্কুল- যার যার মত সে সে চলে। আমি অসংখ্যতে যাওয়ার কথা বলছি না, কিন্তু দুই-একটাতে গেলে আরেকগুলো খবর পায়, অথবা ওইটার অভিজ্ঞতা যদি ১০ জনকে বললে তারা শোনে যে- হ্যাঁ, ‘এটাই তো বটে, আমরা তো করতে পারতাম’। এরকম এই ছোট ছোট কাজ। বড় কাজের কথা বলছি না।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বড় কাজ তো আছেই, করবই- এই ছোট কাজগুলো দিয়েই কিন্তু বড় কাজটা হয়। মানুষ বলে যে- ‘হ্যাঁ, আমাদের সময় উনি যখন ডিসি ছিলেন, আমাদের এখানে উনি এই কাজটা করে গেছেন’। এরকম স্মৃতি আমরা নাগরিকদের কাছ থেকে শুনি, ‘উনি যখন, অমুক যখন ডিসি ছিল- উনি এই কাজটা করে দিয়েছেন’।
“অবদানটা মানুষ স্মরণ করে, মানুষ ভোলে না- ওই যে অবদানটা হয়েছে, সেটা ব্যক্তিগত ইচ্ছাই। এটা সরকারের হুকুমে হয় নাই, সরকার সবাইকে হুকুম দিছে- কিন্তু একজন ব্যক্তিগতভাবে সেটাকে অন্য রকমভাবে, অন্য ভঙ্গিতে নিয়ে এসছে এবং মানুষের মন জয় করেছে।”
তিনি বলেন, “আমাদের সুযোগ এই যে- আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে আছি, এটা একটা মস্ত বড় সুযোগ, আমাদের হাতে অনেকগুলো কাজ এবং খুব সহজ কাজ, কঠিন কাজ না এবং আমি বলছিলাম যে হান্ড্রেড পার্সেন্ট করতে হবে না। আমি বললাম যে টেন পার্সেন্ট করো, ২০ পার্সেন্ট করো, ৩০ পার্সেন্ট করো, এক নাম্বার হও- এক নম্বর হবার চেষ্টা করো; কারণ তোমরা তো সবাই একই লাইনের মধ্যে একই পরিস্থিতিতে আছো।
“এক নম্বর হওয়ার মধ্যে অনেক আনন্দ, ‘আমি করে ফেলেছি, আমি এটা সবার আগে করে ফেলেছি’। এই যে আনন্দটা করা, সেই আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করো না।”