একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে বদরপ্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় সর্বোচ্চ আদালতে বহাল থাকায় বাংলাদেশের সবাই খুশি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
Published : 16 Jun 2015, 10:51 AM
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার এই রায় ঘোষণা করেন। আসামি মুজাহিদের আপিল আংশিক মঞ্জুর হলেও তাকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত রায়েও বহাল থাকে।
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেন, “পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা নেই যেখানে নিজ দেশের নাগরিক, নিজ দেশের বুদ্ধিজীবীদের এরকমভাবে নিধন করা হয়েছে। অর্থাৎ এই যে আজ বিচার হচ্ছে আলবদরদের, জামায়াতে ইসলামী নেতৃবৃন্দের, এরা বাংলাভাষী, এই দেশেরই তারা নাগরিক, অথচ এই দেশেরই বুদ্ধিজীবীদের তারা যেভাবে হত্যা করেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫-৩০ জন শিক্ষক, বিভিন্ন জায়গায় প্রখ্যাত সাংবাদিকদের ও চিকিৎসকদের এভাবে হত্যা করেছে।”
সেই বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়েই মুজাহিদের ফাঁসির রায় এসেছে বলে উল্লেখ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
“আজকে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ব্যাপারে যে রায় আমরা পেলাম, তাতে সারা দেশের বুদ্ধিজীবীরা, এদেশে সংস্কৃতির চর্চা যারা করেন, যারা আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি সমুন্নত রাখেন, এবং যারা আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সমুন্নত রাখার স্বপ্ন দেখেন, তারা সবাই খুশি হবে।”
মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে ১৯৭১ সালের ১৪ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের ভেতরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিকসহ বহু খ্যাতিমান বাঙালিকে হত্যা করে। ওই হত্যাকণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সদস্যরা।
পরে শরীরে নিষ্ঠুর নির্যাতনের চিহ্নসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের লাশ পাওয়া যায় মিরপুর ও রায়েরবাজার এলাকায়। পরে তা বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
মাহবুবে আলম বলেন, “একটা শতাব্দীতেও এমন সাংবাদিক, এমন চিকিৎসক, এমন শিক্ষক জন্মায় না। এই ধরনের লোকজনকে যেভাবে ‘প্ল্যানড ওয়ে’তে, পাক আর্মি সারেন্ডার করবে সেই সময়ে, যখন তাদের জান বাঁচানোর সময়, সেইসময়ে দেখা গেল ১৪ থেকে ১৬ তারিখের ভিতরে এই বুদ্ধিজীবীদের নিধন করা হল। এই নিধনের পিছনে এই আলবদররাই জড়িত।”
এক শতাব্দীতেও এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তবে এইটুকু সান্ত্বনা, বিচার পাওয়া গেল।”
আপিল বিভাগের রায়ে প্রথম অভিযোগে আসামির আপিল মঞ্জুর করে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে। সপ্তাম অভিযোগে তার সাজা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
আর ষষ্ঠ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখে মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আপিল বিভাগ।
মাহবুবে আলম বলেন, “ছয় নম্বর অভিযোগে ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা। এই বুদ্ধিজীবী হত্যার আগে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বক্তৃতায় মুজাহিদ এমনও বলেছেন, দেশের কোনো লাইব্রেরিতে হিন্দু লেখকের কোনো বই থাকতে পারবে না। হিন্দুদের দ্বারা প্রভাবিত কোনো মুসলিম লেখকেরও বই থাকতে পারবে না। এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তারা অ্যাখ্যায়িত করেছেন দুষ্কৃতকারী হিসেবে, তাদের নিধন করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
“কাজেই তাদের এ হত্যাকাণ্ডের পিছনে যে উসকানি, যে প্ল্যান, যে চিন্তাচেতনা সেটা মুজাহিদের ছিল, এটা নানা রকম তথ্য-উপাত্তে স্পষ্টভাবে বেরিয়ে এসেছে। এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য এই ধরনের উসকানিদাতারা, এই ধরনের যারা না কি বদর নেতা হিসেবে কাজ করেছেন, নিশ্চয়ই তারা দায়ী, আদালত সঠিকভাবেই রায় প্রদান করেছেন।”
আপিল আদালত ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে এই রায় দিয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
জাতিকে মেধাশূন্য করার সেই ষড়যন্ত্রের চেয়ে বড় অপরাধ আর হয় না মন্তব্য করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “হিটলারের যে হিংস্রতা এবং এদের যে হিংস্রতা, তাতে আমি কোনো তফাৎ দেখি না।”
এক প্রশ্নের জবাবে “আজ আমি শর্ট অর্ডার চাইনি। আগেরবার চেয়েছিলাম, দেওয়া হয়নি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই আজ চাইনি। আশা করছি শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ রায় পেয়ে যাব।”
২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিতদের মধ্যে মুজাহিদ হলেন চতুর্থ ব্যক্তি, আপিল বিভাগে যার মামলার নিষ্পত্তি হল।