সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস আক্রান্ত অভয়নগর এখন নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠন আর জেলা প্রশাসন, পুলিশ আনসারের নিরাপত্তা টহলে বলা যায় মুখরিত।
Published : 14 Jan 2014, 11:09 AM
আক্রান্ত হিন্দু পরিবারগুলোর কান্না, ক্ষোভ, আতঙ্ক এসবের আড়ালে চাপা পড়ে যায়নি, বরং ছাই চাপা আগুনের মতো ফুঁসছে ঘরে ঘরে।
হামলা ঘটে যাওয়ার ৭ দিন পরও দুমড়ানো-মোচড়ানো টিনের ঘরে বসে মায়া রানী ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন কাঁদতে কাঁদতে। তার কান্নার শব্দ ঢেকে যাচ্ছিল পাশ দিয়ে চলে যাওয়া কোনো এক প্রতিবাদী মিছিলের শ্লোগানে, পুলিশের টহলে। এসবের যেন ওইখানে এখন পাশাপাশি বসবাস।
ঘটনার বর্ণনা ছেড়ে প্রশ্নই ছুড়লেন মায়া রানী, “প্রশাসন, পুলিশ কয় দিন নিরাপত্তা দিবে? খবরওয়ালারা কয় দিন খবর করবে? কম্বল-চাল-ডাল-তেল দিয়ে কয় দিন বুঝ দিয়ে রাখবে? মনে যে ভয় আসছে, সেটা তো যাচ্ছে না। একটা ছোট বাচ্চা জোরে কাঁদলেও আতঙ্ক লাগে। খুব আতঙ্ক। রাতে ঘুমাইতে পারি না।”
যশোর সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অভয়নগর উপজেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনার খবর গণমাধ্যমে এখন আর নতুন খবর নয়। নতুন খবর হলো, প্রেমবাগ ইউনিয়নের চাপাতলা গ্রামের মালোপাড়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার জোরালো উপস্থিতি। প্রায় আধা বর্গকিলোমিটার আয়তনের জেলে এবং মাছ বিক্রেতা পেশায় থাকা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বসতিতে পুলিশ আর আনসারের ব্যাপক উপস্থিতি।
ঘটনার পর দিন থেকে একটা পুলিশ ফাঁড়ি বসেছে। এমন অবস্থা যে কয়েক কদম হাঁটলেই দেখা মিলবে ইউনিফর্ম পরা পুলিশ সদস্য এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসের কোনো না কোনো সদস্যের।
চাপাতলা গ্রামে মালোপাড়া এমন এক জায়গায়, যার গা ঘেঁষেই মুসলিম পাড়া, চোখেপড়ার মত আঘাতচিহ্নহীন। পাড়ার পাশেই নদী, বুড়ি ভৈরব, যে নদী ৫ জানুয়ারিতে আতঙ্কিত হিন্দুদের আতঙ্কে ঝাঁপিয়ে পড়া বা উল্টা পাড়ের দিয়াপাড়ায় পাড়ি দেয়ার নিরব সাক্ষী হয়ে আছে।
পুরো পাড়া ঘুরে দেখা গেল, শিব মন্দিরটি অক্ষত আছে। তবে হামলার শিকার হওয়া সবগুলো বাড়িতে হামলার চিহ্ন এখনো আগের মতোই আছে। ঘরের ভাঙ্গা, দুমড়ানো-মুচড়ানো টিন, টুকরা টুকরা হয়ে পড়ে থাকা টেলিভিশন, আগুনে ঝলসানো ট্রাঙ্ক, পরীক্ষার সার্টিফিকেট, মাছ ধরার পোড়া জাল, ভাঙ্গা আলমারি-সব এখনো সেরকমই আছে।
রাম দা’র কোপে আহত ছয় জন স্থানীয় অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন আছেন।
সন্ত্রাসীদের রাম দায়ের কোপে ভেঙে যাওয়া টিনের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দয়াময় সরকার বললেন, “ঘটনা তো হঠাৎ করে হয়নি। নির্বাচনের আগের দিন বিএনপি -জামাতের কর্মীরা এসে বলে গেছিল ভোট দিতে না যেতে। আবার পরের দিন আওয়ামী লীগের নেতা কর্মী, পুলিশ এসে বলে গেছিল, কোনো অসুবিধা হবে না, তোমরা ভোট দিতে যেও। আর যখন হামলা হয়, তখন থানার ওসি, পুলিশ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ফোন করে কতবার সাহায্য চেয়েছি, কেউ আসেনি। আর এখন কত পুলিশ!”
মালোপাড়ার মানুষেরা ক্ষোভ ঝেড়ে বলছেন, মারামারি হামলা শেষ, আহত, আতঙ্কগ্রস্থ হবার পর ব্যাপক পুলিশি নিরাপত্তা। সাথে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও আসছেন নিয়মিত।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিফাত মেহনাজ বলেন, “অলরেডি ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজ করে যাচ্ছেন। আর আমরা স্থানীয়দের নিয়ে একটা সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছি। এর উদ্দেশ্য হলো হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে কনফিডেন্স লেবেল পুনরুদ্ধার করা।”
মালোপাড়ার ঘরে ঘরে একই গল্প, যে গল্প পাঠক এতোদিনে জেনে গেছেন গণমাধ্যমে। তাদের সদ্য স্মৃতি হয়ে থাকা রাম দা, লাঠি, আগুন এখন পারস্পরিক আলাপে গলায় আটকে থাকা কান্না ঠেলে আহাজারি হয়ে বের হয়ে আসছে।
৮০ বছর বয়সী মৃত্যুঞ্জয় সরকার জানান, হামলার সময় তিনি বুড়ো বলে, তাকে এবং তার বয়সী স্ত্রীকে ঘরে রেখে ছেলে এবং ছেলের বউ তাদের বাচ্চা নিয়ে পালিয়ে যায়।
চোখ মুছে গলার স্বর স্বাভাবিক করে আবার বললেন, “আচ্ছা বলেন তো, এইখানকার সব হিন্দু ভোটার যদি আওয়ামী লীগরে ভোট দেয়, তাইলে কি আওয়ামী লীগ জেতবে? তাইলে কেন আমাদের টার্গেট করলো?”
এ পর্যন্ত সংহতি, সহমর্মিতা জানাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান খান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, গণজাগরণ মঞ্চ, বাম গণতান্ত্রিক মোর্চা, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান পরিষদ।
আর্থিক সহযোগিতা এসেছে জেলা পুলিশ থেকে; তারা তাদের এক দিনের বেতন হিসাবে তিন লাখ ২৫ হাজার টাকা, সরকারের পক্ষ থেকে যশোর জেলা প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ পরিবারকে ৩০ কেজি করে চাল, ৩০ বাণ্ডেল টিন ও তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা, ২০০ পিস কম্বল, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট দিয়েছে ৭০টি মাছ ধরার জাল।