বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সংলাপ শুরুর আহ্বান জানিয়ে তোলা বহু আলোচিত প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট।
Published : 10 Jan 2014, 09:01 AM
গত ৭ জানুয়ারি ১১৩তম কংগ্রেসের প্রথম সেশনেই প্রস্তাবটি গৃহিত হয়, যার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয় ৯ জানুয়ারি।
যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচ সিনেটর রিচার্ড ডারবিন, জন বুজম্যান, বারবারা বক্সার, মাইকেল বি এঞ্জি ও সিনেটর ক্রিস্টোফার এস মার্ফি গত ১১ ডিসেম্বর প্রস্তাবটি পররাষ্ট্রবিষয়ক সিনেট কমিটিতে তোলার এক সপ্তাহ পর সেটি নিয়ে কমিটিতে আলোচনা হয়।
গত মঙ্গলবার সিনেট মোটামুটি সেই প্রস্তাবটিই শিরোনাম কিছুটা বদলে গ্রহণ করায় বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারি ভোটের আগের পরিস্থিতিই সেখানে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বিরোধকে দায়ী করে ওই প্রস্তাবে ছয়টি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
১. বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরাসরি এবং সত্যিকার অর্থে সংলাপে বসতে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
২. লাগাতার রাজনৈতিক অচলাবস্থায় বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে মন্তব্য করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সিনেট।
৩. অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের উদ্যোগ নিয়ে এবং নাশকতার নিন্দা জানিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের পথ সুগম করতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
৪. নির্বাচনে পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা এবং অবাধ গতিবিধির নিশ্চয়তা দিতে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। (যদিও যুক্তরাষ্ট্র গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠায়নি।)
৫. বাংলাদেশের রাজনৈতিক মতবিরোধ দূর করতে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব ফারনান্দেজ-তারানকোর উদ্যোগে শুরু হওয়া আলোচনার প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে সিনেট।
এবং ৬. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে, মানবাধিকার কর্মীদের হেনস্তা বন্ধে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ‘স্বাধীনতা’ ফিরিয়ে দিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
সিনেটে গৃহীত প্রস্তাবের পটভূমিতে যা যা বলা হয়েছে
১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের আলাদা হওয়ার পর থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সময়ে বার বার সামরিক সরকারের ক্ষমতা দখল, বার বার রাজনৈতিক সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপন্ন হয়ে পড়া এবং রাজনৈতিক সংঘাত ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠার প্রেক্ষাপটে সামরিক হস্তক্ষেপে ২০০৭ সালের জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত হওয়া ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা হয়েছে এই প্রস্তাবে।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় থাকা দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বন্দ্বের কারণে জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে বলেও মার্কিন সিনেট মনে করছে।
এতে বলা হয়েছে, সাধারণভাবে বাংলাদেশ ‘সহিষ্ণু’ হিসেবে পরিচিত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় চরমপন্থার উত্থানে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
শত প্রতিকূলতার পরও বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনের সাফল্য ও বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখতে পারায় প্রশংসাও করা হয়েছে এই প্রস্তাবে।
তবে গ্রামীণ ব্যাংকের স্বাধীনতায় ‘সরকারের হস্তক্ষেপের’ সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট।
একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে আন্তর্জাতিক মানের ঘাটতি রয়েছে বলে প্রস্তাবের ভূমিকায় বলা হয়েছে।
বাংলাদেশকে এতে তুলে ধরা হয়েছে ‘উদার ও বৈচিত্র্যময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্রের’ উদারহরণ হিসেবে।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায়ে ১৮ দলীয় জোটের লাগাতার কর্মসূচিতে শতাধিক বাংলাদেশির প্রাণহানি, জাতীয় অর্থনীতির মুখ থুবড়ে পড়া ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সিনেট।
এছাড়া বাংলাদেশে একটি শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফারনান্দেজ-তারানকোর আলোচনা শুরুর উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়েছে।
সিনেটের এই প্রস্তাব প্রসঙ্গে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এ কে এ মোমেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই প্রস্তাবে বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা ফুটে ওঠেনি।
“কারণ ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচন শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশ আগের অবস্থানে নেই, অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র সিনেট প্রস্তাব পাশের আগে সরেজমিনে খোঁজ নেয়ার তাগিদ বোধ করেনি- এটা সত্যি দুঃখজনক।”
প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন ইউএস কমিটি ফর সেক্যুলার ডেমোক্রেটিক বাংলাদেশের সেক্রেটারি জাকারিয়া চৌধুরী বলেন, সিনেটের নেতারা প্রস্তাব গ্রহণের আগে বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি জেনে নিলে তা আরো বেশি গ্রহণযোগ্য হতো।
অবশ্য বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের এই প্রস্তাব পাসকে ‘সময়োপযোগী’ বলেই মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতা শরাফত হোসেন বাবু ও তারেক পরিষদ আন্তর্জাতিক কমিটির চেয়ারম্যান আকতার হোসেন বাদল।
তাদের আশা, যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে সারা দিয়ে বাংলাদেশ সরকার শিগগিরই আলোচনার মাধ্যমে ‘সর্বজনগ্রাহ্য’ নির্বাচনের পথে যাবে।