আনন্দ-বেদনায় স্মরণ শ্রেষ্ঠ সন্তানদের

“আজ কি বাতাসে অক্সিজেন একটু বেশি? বুকের ভেতরে এত হালকা লাগছে কেন?”

শহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Dec 2013, 03:25 AM
Updated : 14 Dec 2013, 12:32 PM

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রাক্কালে নিজেকে এই প্রশ্ন একাত্তরে শহীদ ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে নুজহাত চৌধুরীর।

একাত্তরে নির্মমতার জন্য প্রথম ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দুই দিনের মধ্যে শনিবার দিনটি পালনের আগে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যদের অনুভূতি এই রকমই।

শ্রদ্ধার ফুলের সঙ্গে বিচারের দাবি নিয়ে তাদের মতোই গত চার দশক ধরে যে দিনটি পালন করছিল জাতি, এবার দিনটি ভিন্ন এক মাত্রা নিয়ে এসেছে।

যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির পর নিজের প্রশ্নের উত্তরে নিজেই লিখেছেন নুজহাত- “মা, এবার শান্তিতে ঘুমাও, আমি কাঁদি। কাঁদি তোমার জন্য, কাঁদি আমার জন্য, এ অভাগা দেশের জন্য, এ বীর জাতির জন্য, এই দায়মুক্তির সুযোগের জন্য।

“তারুণ্য আজ উল্লাস করছে, এটা তাদের বিজয়। এ বিজয়ের উল্লাসে আমিও উল্লসিত। আমিও হাসছি, অথচ দুচোখ দিয়ে দরদর করে অশ্রু ঝরে পড়ছে। অনন্য এক অনুভূতি।”

“৭১-এর বিজয়ের অনুভূতি এমনই ছিল, যখন ১৬ ডিসেম্বর জাতি বিজয় লাভ করল ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে, ৪ লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে। আনন্দ-বেদনার এ কী অপূর্ব মিলন!”

স্বাধীনতার উষালগ্নে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের যে দোসরদের সহায়তায় দেশের মেধাবী সন্তানদের হত্যা করেছিল, তার মধ্যেই একজন ছিল জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা; একাত্তরে যার কুখ্যাতি ছিল ‘কসাই কাদের’ নামে।

এই রাষ্ট্রীয় আয়োজনের পাশাপাশি সব মানুষের স্মরণের মধ্য দিয়ে ভোর থেকেই চলছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের আনুষ্ঠানিকতা; যা ছাপিয়ে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে সমবেত মানুষের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে জয়ের তৃপ্তি, যা চার দশক ধরে মলিন ছিল যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফালন আর তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকার উড্ডয়ন দেখে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রায় চার দশক পর নেয়া উদ্যোগে এই বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে শেষ করার অঙ্গীকার করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। 

মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “জাতির কলঙ্ক মোচনের প্রথম ধাপ শেষ হয়েছে।

“শেখ হাসিনা যে কথা দেন, তা শেষ করেন। এটা জাস্ট প্রথম। হোপফুলি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাকি বিচারও হবে এবং বিচারের রায় কার্কর হবে। যারা দেশের বাইরে রয়েছে, তাদের ফিরিয়ে এনে বিচার করা হবে।”

এর আগে সকালে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৭টা ৫ মিনিটে তারা যখন ফুল দেন শহীদ বেদীতে, তখন শহীদ স্মরণে বিউগলে বাজছিল করুণ সুর।

মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা জানানোর পর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ফুল দেন শহীদ বেদীতে।

এরপর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আবার ফুল দেন শেখ হাসিনা। পরে তিনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন।

এরপর স্মৃতিসৌধ সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য খুলে দেয়া হয়, নামে জনতার ঢল। এর মধ্যেই সোয়া ৯টার দিকে শ্রদ্ধা জানান বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ছাড়াও সর্বস্তরের মানুষ শহীদ বেদীতে দিয়ে যায় শ্রদ্ধা আর ভালবাসার ফুল।

মিরপুরের পাশাপাশি রায়েরবাজারে বধ্যভূমি স্মতিসৌধেও ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হয়।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিকসহ বহু খ্যাতিমান বাঙালিকে হত্যা করে। এই হত্যাকণ্ডে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সদস্যরা। 

পরে শরীরে নিষ্ঠুর নির্যাতনের চিহ্নসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের লাশ পাওয়া যায় মিরপুর ও রায়েরবাজার এলাকায়। পরে তা বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি তাদের রক্ষাকর্তা এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের বিচারের কথাও বলেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।   

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের বাণীতে তিনি বলেন, “এই কুখ্যাত মানবতাবিরোধীদের যারা রক্ষার চেষ্টা করছে, তাদেরও একদিন বিচার হবে। এসব রায় বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মা শান্তি পাবে। দেশ কলঙ্কমুক্ত হবে।”

বলা হয়, পরাজয় নিশ্চিত জেনেই পাকিস্তানি বাহিনী দেশের মেধাবী সন্তানদের হত্যার পরিকল্পনা করে, যার উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের পুনর্গঠন বাধাগ্রস্ত করা।

“ওরা ভেবেছিল, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করলেই এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব দুর্বল হয়ে পড়বে এবং উন্নয়ন অগ্রগতি রুদ্ধ করে দেয়া যাবে। কিন্তু তাদের সে লক্ষ্য ব্যর্থ হয়েছে,” শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের বাণীতে বলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।