ঘুষ হিসাবে আদায়ের পর ২০ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের মামলায় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানকে বেকসুর খালাস দিয়েছে আদালত।
Published : 17 Nov 2013, 11:19 AM
তবে তারেকের বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে সাত বছর কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৪০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে।
ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ মো. মোতাহার হোসেন রোববার এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করার প্রায় চার বছর পর এ মামলার রায় এলো।
মামলা দায়ের থেকে শুরু করে পুরো বিচার প্রক্রিয়াতেই অনুপস্থিত ছিলেন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক। গত পাঁচ বছর ধরে তিনি যুক্তরাজ্যে রয়েছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোও মুদ্রা পাচারের আরেকটি মামলায় কারাদণ্ডাদেশ নিয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন।
রয়ের পর আদালত কক্ষেই উল্লাসে ফেটে পড়েন বিএনপি সমর্থক আইনজীবরা। অন্যদিকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় রাষ্ট্রপেক্ষের আইনজীবীদের।
রায়ের সময় তারেকের ব্যবসায়িক অংশীদার মামুন কাঠগড়াতেই ছিলেন। রায়ের পর তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে রাজি হননি।
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, এই রায়ে তারেক ন্যায়বিচার পেলেও মামুন তা পাননি। অবশ্য ইতোমধ্যে প্রায় সাত বছর কারাগারে থাকা মামুন অচিরেই মুক্তি পাবেন বলে তারা আশা প্রকাশ করেছেন।
লন্ডনে সম্প্রতি বিএনপির এক অনুষ্ঠানে তারেক রহমান
আদালতে গিয়াসউদ্দিন আল মামুন
খালাস যে কারণে
ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানায় ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর দায়ের করা এ মামলায় তারেক-মামুনের বিচার শুরু হয় ২০১১ সালের ৬ জুলাই।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, টঙ্গীতে প্রস্তাবিত ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ নির্মাণ কনস্ট্রাকশনস নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পাইয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ঘুষ নেন মামুন।
২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পন্থায় ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৮৪৩ টাকা সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংকে মামুনের হিসাবে পাচার করা হয়, যার মধ্যে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা তারেক খরচ করেন বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়।
৩৭ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারক বলেন, ওই টাকা খরচ করার কথা তারেক রহমান অস্বীকার করেননি। ২০০৭ সালে দুদকে দাখিল করা তারেকের হিসাব বিবরণীতে তার উল্লেখ রয়ছে। তিনি যে মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ করেছেন তা প্রমাণ হয়নি।
রায়ে বলা হয়, প্রধান সাক্ষী নির্মাণ কনস্ট্রাকশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাদিজা ইসলাম তার জবানবন্দিতে বলেছেন, ঘুষ নয়, ‘কনসালটেন্সি ফি’ হিসাবে মামুনকে তিনি ওই অর্থ দিয়েছিলেন। মামুনও আত্মপক্ষ সমর্থনে দেওয়া বক্তব্যে ওই টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
“কিন্তু অর্থ ফি হিসাবে নেয়ার মতো কনসালটেন্সি ফার্ম মামুনের ছিল না। ওই টাকা অনৈতিকভাবে চাপ দিয়ে নেয়া হয়েছে মর্মে প্রমাণিত হয়েছে। চাঁদাবাজির অভিযোগে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা হয়েছিল। এ কারণে ওই টাকা দেশে গ্রহণ করলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে- এমন আশঙ্কায় বিদেশে টাকা গ্রহণ করা হয়, যা মানি লন্ডারিং আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।”
অন্যদিকে তারেক ভয় দেখিয়ে মামুনের মাধ্যমে অর্থ আদায় করেছেন- এ অভিযোগ প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়।
বিচারক আদেশে বলেন, মামুনের সাজা থেকে তার হাজতবাসকালীন সময় বাদ যাবে। আর মামুনের সিঙ্গাপুরের ব্যাংক হিসাব থেকে ফিরিয়ে আনা ২০ কোটি ৪১ লাখ টাকা সরকারের কোষাগারে জমা করে গেজেট প্রকাশ করতে হবে। দুটি বহুল প্রচারিত পত্রিকায় তা বিজ্ঞাপন আকারেও প্রচার করতে হবে।
অবশ্য মামুনের হাজতকালীন সময় ২০০৭ সালের ২৬ মার্চ তার গ্রেপ্তারের সময় থেকে, না কি ২০০৯ সালের ২ নভেম্বর এ মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর সময় কার্যকর হবে- রায়ে তা স্পষ্ট হয়নি।
তার আইনজীবী মো. জাহেদুল ইসলাম কোয়েল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মামুনের বিরুদ্ধে থাকা ২৩টি মামলার মাধ্যে এই প্রথম কোনো মামলায় তিনি দণ্ডাদেশ পেলেন।
এছাড়া পাঁচটি মামলায় তিনি খালাস পেয়েছেন, একটি মামলা চলছে এবং বাকিগুলোর কার্যক্রম হাই কোর্টের আদেশে স্থগিত রয়েছে।
অন্যদিকে তারেকের আইনজীবী জয়নাল আবেদীন মেজবাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তারেকের বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা ছিল ও একটি সাধারণ ডায়েরির মধ্যে দুটি মামলা ও একটি সাধারণ ডায়েরি থেকে তিনি খালাস পেয়েছেন।
জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলা, ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার দুই মামলা এবং সোনালী ব্যাংকের দায়ের করা ডান্ডি ডাইয়িংয়ের ঋণ খেলাপির মামলা চলছে এবং বাকি ১০টি মামলার কার্যক্রম হাই কোর্টের আদেশে স্থগিত রয়েছে।
রায়ের আগে আদালত প্রাঙ্গণের নিরাপত্তা
রায়ের পর বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মিষ্টি বিতরণ
রায়ের আগে ও পরে
বেলা ১১টায় এ মামলার রায় ঘোষণা শুরুর কথা থাকলেও বিচারক মো. মোতাহার হোসেন আদালতকক্ষে পৌঁছান ১২টার দিকে। তার ঘণ্টা দুই আগেই মামুনকে কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসা হয় এবং এজলাস ও আদালত প্রাঙ্গণে জড়ো হন বিএনপি সমর্থক বিপুল সংখ্যক আইনজীবী।
রায়কে কেন্দ্র করে আদালত পাড়া ও আশেপাশের এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। আদালতের বিভিন্ন প্রবেশ পথ ও বিচার কক্ষের সামনে বসানো হয় আর্চওয়ে। আইনজীবীদের তল্লাশি করে আদালত প্রাঙ্গণে ঢুকতে দেয়া হয়।
‘অফ হোয়াইট’ শার্ট পরিহিত মামুনকে বিচারক আসার আগে কিছুক্ষণ পত্রিকা পড়তে দেখা যায়।বিচারক এজলাসে আসার পর মামুনকে দাঁড় করানো হয় কাঠগড়ায়।
এ সময় বিচার কক্ষে উপস্থিত রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের নিরাপত্তা দিতে তাদের পেছনে অবস্থান নেন বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য, যা সাধারণত দেখা যায় না।
বিচারক প্রথমে গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের রায় ঘোষণা করেন,যাতে তাকে সাত বছর কারাদণ্ডের পাশাপাশি অর্থদণ্ডও দেয়া হয়।
এরপর তিনি তারেককে বেকসুর খালাস দিয়েই নিজের খাস কামরায় চলে যান।
এই রায়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা আদালতকক্ষেই উল্লাস শুরু করেন। নিচে আদালত প্রাঙ্গণে শুরু হয় আনন্দ মিছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে মিষ্টি বিতরণও শুরু হয়।
এ সময় শ্লোগান শোনা যায়- ‘বাকশালিদের দিন শেষ, তারেক জিয়ার বাংলাদেশ’।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান। একজনকে বলতে শোনা যায়, “এ রায় মানি না”।
এ সময় একজন আইনজীবী আদালত কক্ষের দড়জায় ধাক্কাও দেন। দুদকের আইনজীবী আনিসুল হক বের হওয়ার সময় ‘ধর ধর’ বলে চিৎকার করতে শোনা যায় সরকার সমর্থক কয়েকজন আইনজীবীবকে।
দুদকের আইনজীবী আনিসুল হক
আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহাবুব হোসেন
প্রতিক্রিয়া
দুদকের প্রধান আইনজীবী আনিসুল হক রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, “নিশ্চই আমরা এ রায়ে সন্তুষ্ট নই। পূর্ণাঙ্গ রায় না পড়ে কিছু বলব না।”
একই কথা বলেন দুদকের আরেক আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল।
অন্যদিকে আসামিপক্ষের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহাবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “এতোদিন তারেক রতমানের বিরুদ্ধে যে মিথ্যা প্রচার হয়েছে, এ রায়ের মধ্য দিয়ে তার অবসান হলো। রায়েই প্রমাণ হলো- তারেক দুর্নীতি করেননি, অর্থ পাচার করেননি। আমরা এগিয়ে যাব।”
মামুনের আইনজীবী খায়রুল ইসলাম লিটন বলেন, “মামুনের প্রতি রায়ে অবিচার করা হয়েছে। আর তারেকের ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষ তো কোনো সাক্ষ্য প্রমাণই হাজির করতে পারেনি।”
আসামিপক্ষের আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, “তারেক ন্যায়বিচার পয়েছেন, মামুন পাননি। তার জন্য আমরা উচ্চ আদালতে যাব।
রায়ের পর বিএনপির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “আমরা এই রায়ের জন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি। এই রায়ে প্রমাণ হয়েছে, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একটি মহল বিশেষের বিভিন্ন অভিযোগ ছিলো ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’’
অন্যদিকে এই রায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি বলেছে, এতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের দুর্নীতি উৎসাহিত হবে।
জরুরি অবস্থা জারির পর ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেককে গ্রেপ্তার করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে পরের বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্য যান।
স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তখন থেকে সেখানেই রয়েছেন তারেক। সম্প্রতি সেখানে দলীয় কয়েকটি অনুষ্ঠানেও তাকে অংশ নিতে দেখা গেছে।