ফাঁসির দাবি নিয়ে ভারতে যাচ্ছেন ফেলানীর বাবা

হত্যাকারী বিএসএফ সদস্যদের ফাঁসির দাবি নিয়ে ভারত যাচ্ছেন বহুল আলোচিত কুড়িগ্রামের কিশোরী ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম নুরু।

আহসান হাবীব নীলু কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 August 2013, 02:19 PM
Updated : 13 August 2013, 03:30 PM

কুড়িগ্রামের অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন কিশোরী ফেলানী। কাঁটাতারে গুলিবিদ্ধ ফেলানীর ছবি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসার পর এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশ-বিদেশে তখন সমালোচনার ঝড় ওঠে।

হত্যাকাণ্ডের প্রায় আড়াই বছর পর আগামী মঙ্গলবার (১৩ অগাস্ট) কোচবিহারে বিএসএফ এর একটি বিশেষ আদালতে এর বিচার শুরু হচ্ছে।

মামলায় সাক্ষ্য দিতে ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম নুরু, মামা আব্দুল হানিফ, কুড়িগ্রাম জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর এস এম আব্রাহাম লিংকন, বিজিবি-৪৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউল হক খালেদ আগামী ১৮ অগাস্ট ভারত যাচ্ছেন।

সোমবার দুপুরে নাগেশ্বরী উপজেলার দক্ষিণ রামখানা ইউনিয়নের বানার ভিটা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পেছনে ছোট একটি সুপারি বাগানের শেষপ্রান্তে ফেলানীর কবরটি ঝোপজঙ্গলে পূর্ণ। কবরের বেড়া ভেঙে গেছে। গাদা ফুলের দু’একটি গাছ পরিচর্যাহীনভাবে টিকে আছে।

দীর্ঘ আড়াই বছর পর বিচার শুরু হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম নুরু বলেন, “লোকজন সবাই দেখছে, আমিও দেখছি ওরা মেয়েডারে কিভাবে গুলি কইরা মারছে। যা ঘটনা হইছে, সব কইমু আদালতে। যারা মেয়েডারে মারছে, তাদের যানি ফাঁসি হয়।”

ফেলানীর কথা উঠতেই শাড়ির আঁচলে মুখ মুছেন তার মা জাহানারা বেগম।

ফেলানীর কবরের পাশে বাবা ও মা

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, “বাচ্চাটারে (ফেলানী) নিয়া খুব আশা করছিলাম। ওরে ভালভাবে বিয়া দিব। বিএসএফ তা করতে দেয় নাই। মেয়ের মরা মুখটাও দেখতে পাই নাই। এহন বিচার হইলে অনেক শান্তি পামু।”

বিয়ের জন্যই ভারত থেকে নিজ বাড়িতে ফিরছিলেন ফেলানী। হত্যাকাণ্ডের পর ফেলানীর লাশ প্রথম গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসেন তার মামা আব্দুল হানিফ।

হানিফ বলেন, “ঘটনা শোনার পর আমি ছুটে যাই। মেয়েডারে কাঁটাতারে যেভাবে ঝুলতে দেখছি, চোখের সামনে এহনও ভাসে। আমি আদালতে সব ঘটনা খুলে কমু। উচিত বিচার চাইমু।”

ফেলানীর গ্রামের প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, এ বিচারে তারা খুব খুশি। তারা মনে করেন, বিচার এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়। সীমান্তের মানুষ শান্তিতে বাস করতে পারে।

ফেলানী হত্যাকাণ্ডের বিচারে সাক্ষ্য দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কুড়িগ্রাম বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউল হক খালেদ এবং আইনজীবী আব্রাহাম লিংকন।

বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউল হক খালেদ বলেন, “ন্যায়বিচার পাব বলে আশা করছি।”

ফেলানী হত্যাকাণ্ডের পর সরকার এ পরিবারটিকে সহায়তা দিলেও পাঁচ সন্তান নিয়ে কষ্টের মধ্যের মধ্যেই দিন কাটাতে হচ্ছে নুরুল ইসলাম ও জাহানারা বেগমকে।

তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পরিবারটিকে তিন লাখ টাকা সহায়তা দেন। এরমধ্যে থাকার ঘরটি মেরামত করা ছাড়াও বাড়িতে ও নাখারজান বাজারে দুটি ছোট আকারের মুদি দোকান দেন নুরুল ইসলাম।

দোকানের আয়েই চলে ফেলানীর সাত সদস্যের পরিবার। এর মধ্যে বাকিও বিস্তর বলে জানান ফেলানীর মা।

ভাইবোনদের মধ্যে মালেকা সপ্তম শ্রেণিতে, জাহানুদ্দিন ষষ্ঠ শ্রেণিতে, আরফান চতুর্থ শ্রেণিতে, আক্কাস তৃতীয় শ্রেণিতে ও কাজলি কওমি মাদ্রাসায় পড়ে।

ফেলানীর মার আফসোস, “পাঁচটা বাচ্চার লেখাপড়া করাতে লাগে, প্রারাইভেটের টাকা লাগে, খাওয়া দিতে লাগে, কাপড়-চোপড় লাগে; আমরাতো আর পারতেছি না। চিন্তায় আমাগো ঘুম আসে না। আমরা কুনু কুল পাইতেছি না। সরকারের লোকজন দেখভাল করে না, খবরও নেয় না।”

২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের অনন্তপুর সীমান্তে পঞ্চদশী ফেলানীকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ ১৮১ ব্যাটালিয়নের চৌধুরীহাট ক্যাম্পের জওয়ানরা।

ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম নূরু ১০ বছর ধরে দিল্লিতে কাজ করতেন। তার সঙ্গে সেখানেই থাকতো ফেলানী।

দেশে বিয়ে ঠিক হওয়ায় বাবার সঙ্গে ফেরার পথে সীমান্ত পার হওয়ার সময় কাঁটাতারের বেড়ায় কাপড় আটকে যায় ফেলানীর। এতে ভয়ে সে চিৎকার দিলে বিএসএফ সদস্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে এবং পরে লাশ নিয়ে যায়।

এ ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়।

বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির পক্ষ থেকেও বিএসএফের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকে ফেলানী হত্যার বিচারের জন্য চাপ দেয়া হয়।

গত ২ অগাস্ট বিজিবির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত মার্চে নয়াদিল্লীতে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে ফেলানী হত্যার বিচার দ্রুত শুরু করা হবে বলে আশ্বাস দেন বিএসএফের মহাপরিচালক।

এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি বিএসএফ সদর দপ্তর সম্প্রতি ‘জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স কোর্ট’ গঠন করে এবং আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য বাংলাদেশের দুইজন সাক্ষী, একজন আইনজীবী এবং বিজিবির একজন প্রতিনিধিকে ভারতে যেতে বলা হয়।