‘প্রমাণিত হয়েছে, সাঈদী ছিলেন রাজাকার’

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী যে পিরোজপুরে রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন, প্রসিকিউশন তা সফলভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। 

গোলাম মুজতবা ধ্রুবসুলাইমান নিলয় ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Feb 2013, 00:24 AM
Updated : 28 Feb 2013, 00:54 AM

জামায়াতের নায়েবে আমির সাঈদীর উপস্থিতিতে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলার রায়ে ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারপতি আনোয়ারুল হক এ কথা বলেন।

বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৯ মিনিটে সাঈদীকে কাঠগড়ায় নিয়ে আসার পর এজলাসে আসন গ্রহণ করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর এবং দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক।

বিচারপতি ফজলে কবীর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেয়ার পর সোয়া ১১টার দিকে আনোয়ারুল হক ১২০ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসারের প্রথম অংশ উপস্থাপন শুরু করেন।   

রায়ের জন্য সাঈদীকে সকালেই কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয়। রায় ঘোষণার আগে আদালতের এজলাসে তাকে একটি চেয়ারে বিমর্ষ বসে থাকতে দেখা যায়। এসময় তার পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় খয়েরি রঙের হাতের কাজ করা টুপি ও ডানহাতে কালো চামড়ার বেল্টের ঘড়ি। এ সময় তাকে কিছুটা দুঃচিন্তাগ্রস্ত মনে হচ্ছিল।

রায় পড়া শুরুর আগে বিচারপতি ফজলে কবীর উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, “এই মামলা যার বিরুদ্ধে তিনি বাংলাদেশে অত্যন্ত সুপরিচিতি। তার ওয়াজ শুনতে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ ভিড় করে।” 

“দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী কেবল মাওলানা হিসোবেই সুপরিচিত নন, তিনি দুইবার সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন।”

“তার আরেকটি পরিচয় হলো, তিনি জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির।”   

এভাবে আসামির পরিচয় দেয়ার পর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, “আজ এখানে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার রায় হচ্ছে না। দুই বারের সংসদ সদস্য বা জামায়াতের নেতা সাঈদীরও রায় দিচ্ছে না ট্রাইব্যুনাল।”

“আজ যার বিরুদ্ধে রায় দেয়া হচ্ছে, তাকে জানতে হলে আমাদের চল্লিশ বছর পেছনে তাকাতে হবে। তখন পিরোজপুরে সাঈদীকে মানুষ চিনত দেলু নামে।”  

বিচারপতি ফজলে কবীর বলেন, সেই সময়ের ৩০ বছরের যুবক সাঈদী ছিলেন রাজাকার বাহিনীর একজন সদস্য। উর্দু ভাল বলতে পারতেন বলে পাকিস্তানি সেনাদের সব অপারেশনেই তিনি তাদের সঙ্গে ছিলেন।

যে ২০টি অভিযোগে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার হয়েছে তাতে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও নির্যাতনের মতো ঘটনা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন ট্রাইব্যুনাল।

এরপর রায়ের সংক্ষিপ্তসার পড়া শুরু করেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক।

এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন সফলভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাঈদী পিরোজপুরে রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন।

রাজাকার, আলবদর, আল শামসের মতো এসব আধাসামরিক বাহিনীর সহায়তায় একাত্তরে দেশজুড়ে হত্যা নির্যাতন চালায় পাকিস্তানি সেনা বাহিনী।   

সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০ অভিযোগের মধ্যে ১, ২, ৩, ৪, ৫ ও ১৩ নম্বর অভিযোগের বিষয়ে রায়ের প্রথম অংশ বক্তব্য দেন বিচারপতি বিচারপতি আনোয়ারুল হক। এরপর বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন রায়ের দ্বিতীয় অংশ পড়া শুরু করেন।

২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে বহু প্রতীক্ষিত এই বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর এটি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধের মামলার তৃতীয় রায়। 

প্রথম রায়ে গত ২১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল-২ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ দেয়।

আর একই ট্রাইব্যুনালে ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে তার ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন চলছে সারা দেশে।

দুই ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের সাবেক ও বর্তমান আমিরসহ আরো পাঁচ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর শুনানি চলছে।

রায় উপলক্ষ্যে বুধবার থেকেই ট্রাইব্যুনাল ঘিরে নেয়া হয়েছে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশ বলছে, যে কোনো ধরনের নাশকতার চেষ্টা ঠেকাতে তারা প্রস্তুত।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরে হত্যা, লুণ্ঠনসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের করা একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেপ্তার করা হয় সাবেক সংসদ সদস্য সাঈদীকে। পরের বছর ১৪ই জুলাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটক জামায়াত নেতাদের মধ্যে দলটির নায়েবে আমির সাঈদীর বিরুদ্ধেই সবার আগে অভিযোগ গঠন হয়। একাত্তরে ৩ হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ভাংচুর ও ধর্মান্তরে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ২০টি ঘটনায় ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে তার বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

একই বছরের ৭ ডিসেম্বর এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনসহ মোট ২৮ জন রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন।

এছাড়া তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া ১৫ সাক্ষীর জবানবন্দি ট্রাইব্যুনাল সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করে। আসামিপক্ষে ১৭ জনের সাফাই সাক্ষ্য শেষ হয় গত ২৩ অক্টোবর।

চলতি বছর ২৯ জানুয়ারি যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন বিচারক।