ক্ষুদ্র জাতির ভাষা রক্ষা করতে হবে: মতিন

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় সরকারের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন। ভাষা আন্দোলনে যুক্ত সবাইকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’র আমিনূর রহমান রাসেল ও সুলাইমান নিলয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন অশীতিপর এই ভাষাসৈনিক।

সুলাইমান নিলয়আমিনূর রহমান রাসেল ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Feb 2010, 05:06 AM
Updated : 8 Oct 2014, 11:54 AM

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় সরকারের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃত না করে আন্দোলনে যুক্ত সবাইকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। তার মতে, মানুষের স্বার্থপরতার কারণে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসও অনেক বিকৃত হয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেছেন, ‘এতে দেশের ক্ষতি হয়ে যাবে। ইতিহাসকে ইতিহাসের নিজস্ব গতিপথে চলতে দিতে হবে।’

অশীতিপর মতিন মনে করেন, ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও আরো যে স্বপ্ন তাদের ছিলো তা বাস্তবায়িত হয়নি। 

বর্তমান ছাত্র ও তরুণ প্রজন্মকে স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে নতুন নতুন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

দেশে বিদ্যমান ক্ষুধা, দারিদ্র, অশিক্ষা, কুশিক্ষা ইত্যাদি সমস্যা মাঝে মাঝে খুব পীড়া দেয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে এ সব সমস্যামুক্ত একটি দেশ আমরা দেখতে চেয়েছিলাম। তবে শাসক শ্রেণীর অবহেলা ও বাস্তবমুখী কর্মকাণ্ডের অভাবে তা সম্ভব হয়নি।’

১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার যমুনা নদীর তীরে উমরপুরে আবদুল মতিনের জন্ম। ৮৪ বছর বয়সী ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন চলাচলে প্রায় অক্ষম এখন। মানুষের মুখে কথা ফোটাতে সংগ্রাম করেছেন যে মতিন তিনি এখন নিজে ঠিক মতো কথা বলতে পারেন না। তবুও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইলে উদ্দীপ্ত তরুণের মতো অর্নগল বলেছেন। বলেছেন সেই সময়ের কিছু প্রিয়-অপ্রিয় কথা এবং বর্তমান-ভবিষ্যৎ প্রজম্মের করণীয় সম্পর্কে।

১৯৫০ সালে গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসাবে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে তিনি হয়ে উঠেন ভাষা সৈনিক মতিন।

এই ভাষা সৈনিক ’৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে হারান বাবা আব্দুল জলিল ও ছোট ভাই মনু মিয়াকে।

হানাদাররা জ্বালিয়ে দেয় তার ঘর-বাড়ি। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র ছিলেন। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এই ভাষা সৈনিককে ২০০৮ সালে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে তিনি স্ত্রী ও কন্যাকে ঢাকার মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটিতে বসবাস করছেন।

শনিবার সকালে তার বাসভবনে ভাষা আন্দোলন ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’র।

দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি সত্ত্বার ভাষা ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমাদের মাতৃভাষা যেমন বাংলা তেমনি তাদেরও স্বতন্ত্র ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। এ ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা ও বিকাশে সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে। জাতি হিসাবে তাদের টিকে থাকার সুযোগ দিতে হবে। তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দমিয়ে রাখার কোন চেষ্টা করা যাবে না। সরকারও যেন এরকম কোনো বিরোধ সৃষ্টি না করে।’

ভাষা আন্দোলনে অসম্প্রদায়িক চেতনার সঙ্গে তমদ্দুন মজলিশের বিরোধ সর্ম্পকে আবদুল মতিন বলেন, ‘চেতনার সাথে চেতনার দ্বন্দ্ব পৃথিবীর সর্বত্র বিদ্যমান। ভাষা আন্দোলন চলাকালেও তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটা দ্বন্দ্ব ছিলো। এ বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই আমরা ভাষা আন্দোলন এগিয়ে নিয়েছিলাম। এটা কোন সমস্যা না। তবে যখন কেউ তার ভূমিকাকে বড় করে উপস্থাপন করতে চায়, তখন সমস্যার সৃষ্টি হয়।’

সম্প্রতি তমদ্দুন মজলিসের একটি সভায় অংশ নেয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি তাদের বলেছি সবার অবদানের সঠিক মাত্রা যেন প্রকাশ করা হয়। ভাষা আন্দোলনে অনেকে শহীদ হয়েছে, অনেকে মিছিলে অংশ নিয়েছে। কেউ আবার শহীদ মিনার বানিয়ে. গান গেয়ে, কবিতা লিখে এ আন্দোলনে অবদান রেখেছে। তাদের সবার যথার্থ মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন।’

৫২’র উত্তাল দিনগুলোতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পাশাপাশি সক্রিয় ছিল তমদ্দুন মজলিস।

এ প্রসঙ্গে ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন বলেন, “ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মোহাম্মদ তোহা, অলি আহাদ প্রমুখ বলতেন আমরা এ সংগঠনে স্বস্তি বোধ করছি না। তারা বলতেন, এ সংগঠনের মাধ্যমে আন্দোলন করলে এটি হিন্দু -মুসলমানদের আন্দোলনের অভিন্ন প্ল্যাটফর্ম হিসাবে গড়ে উঠবে না।”

ভাষা আন্দোলন মূলত রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, “ভাষা আন্দোলনের সময় উর্দুভাষী ছিল শতকরা ২২ ভাগ। বাংলাভাষী ছিল শতকরা ৫৬ ভাগ। এ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাড়িয়ে আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলাম এবং সফলও হয়েছি।”

ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় জাতি যেভাবে তাকে সম্মান করেছে তাতে আনন্দিত ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন।