জেএমবি'র বোমা বিশেষজ্ঞ আটক, বিস্ফোরণ ঘটালো স্ত্রী

রাজধানীর শেওড়াপাড়ার উত্তর পীরেরবাগে জেএমবির আস্তানায় পৌনে চার ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান শেষে বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ২টার দিকে জেএমবি সদস্য জাহেদুর রহমান ওরফে বোমা মিজানের স্ত্রী শারমীন হক লতাকে আটক করেছে র‌্যাব।

গোলাম মর্তুজাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 May 2009, 03:52 PM
Updated : 17 August 2018, 08:19 AM

অভিযানের সময় লতার ঘটানো বোমার বিস্ফোরণে তার ডান হাতের কব্জি উড়ে গেছে। রক্তমাখা অবস্থায় তার ২ শিশু সন্তানকেও উদ্ধার করা হয়। এদের একজনের বয়স ২ মাস। অন্যটির বয়স ২ বছর।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জামায়াতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) এর বোমা বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত মিজানকে গ্রেপ্তারের পর তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী রাত সাড়ে ১০ টার দিকে তার পীরেরবাগের বাসায় অভিযান শুরু করে র‌্যাব। এসময় বাসার ভেতর থেকে মিজানের স্ত্রী একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় এবং প্রায় পৌনে ৪ ঘণ্টা দরজা বন্ধ করে রাখে। পরে র‌্যাব সদস্যরা তাকে বুঝিয়ে বাসার বাইরে বের করে আনতে সক্ষম হন।

অভিযান শেষে মিজানের বাসা থেকে দু'টি গ্রেনেড, একটি অবিস্ফোরিত বোমা ও ২টি ম্যাগজিনসহ একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার একটি দল সন্ধ্যায় জেএমবি সদস্য মিজানকে আটকের পর তাকে নিয়ে ৬১/৩ উত্তর পীরেরবাগের ওই বাড়িতে অভিযান শুরু করে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে র‌্যাব সদস্যরা বাড়িটির তিন তলায় মিজানের ফ্ল্যাটে যায়। এসময় দরজায় টোকা দিয়ে মিজান তার স্ত্রীকে বলে, "তুমি কেমন আছো, আমি অসুস্থ।" পরক্ষণেই ফ্ল্যাটের ভেতরে দরজার সামনে একটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।

বিস্ফোরণের পরপর র‌্যাব সদস্যরা মিজানকে নিয়ে নীচতলায় নেমে আসে। তারা মিজানকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে।

মিজান র‌্যাবকে জানান, বাসায় তার স্ত্রী শারমিন হক লতা ও দুই শিশুসন্তান রয়েছে। তার স্ত্রীরও বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রশিক্ষণ রয়েছে। তার বাসায় একাধিক বোমা ও আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে বলে সে জানায়।

র‌্যাব কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, মিজান যখন দরজায় টোকা দিয়ে কথা বলছিল তখন সে তার স্ত্রীকে কোনও সংকেত দেয়, যা পূর্ব পরিকল্পিত। আর সংকেত পেয়েই তার স্ত্রী বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এরপর তারা আরও বিস্ফোরণের আশঙ্কায় সতর্কতার সঙ্গে অভিযান চালান।

র‌্যাব সদস্যরা ওই ফ্ল্যাটের দরজার সামনে বালু ও খোয়ার বস্তা দিয়ে প্রতিরক্ষা বুহ্য গড়ে তোলে। ওই সময় র‌্যাব ও পুলিশ পুরো বাড়িটি ঘিরে রাখে।

পরে পাশের একটি ভবনের তিনতলা থেকে র‌্যাব সদস্যরা হ্যান্ডমাইকে মিজানের স্ত্রী লতার সঙ্গে কথোপকথন শুরু করেন। তারা লতাকে দরজা খুলে বেরিয়ে আসার অনুরোধ জানান। কিন্তু ভেতর থেকে সে চিৎকার ও কান্নাকাটি করে বলে, বোমাটি তার হাতেই বিস্ফোরিত হয়েছে। এতে হাত ও পাসহ তার দেহের বিভিন্নস্থানে জখম হয়েছে। তাই সে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে পারছে না। তার ছোট দুই শিশুপুত্রও আহত হয়েছে বলে লতা জানায়।

র‌্যাব সদস্যরা তখন লতাকে বলে "আপনি বেরিয়ে আসুন, বাইরে এ্যাম্বুলেন্স ও চিকিৎসকরা অপেক্ষা করছেন।"

বোরখা পরিহিতা লতার পোশাকে আরও বিস্ফোরক থাকতে পারে সন্দেহে র‌্যাব সদস্যরা তাকে বোরখা খুলে আসতে বলে। সে রাজি হয় না। প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় বোঝানোর পর সে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে রাজি হয়।

এরই মধ্যে জানালা দিয়ে দেখা যায় তার রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হাত ও শরীর। র‌্যাব সদস্যরা এতে আরও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।

এরই মধ্যে কেটে যায় শ্বাসরুদ্ধকর পৌনে চার ঘণ্টা। রাত সোয়া ২টার দিকে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে লতা।

তার ডান হাতের কব্জি ছিন্নবিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল। পুরো শরীর ছিল রক্তাক্ত। তার দুই শিশুপুত্রও ছিল রক্তমাখা। র‌্যাব সদস্যরা লতাকে প্রথমে স্থানীয় গ্যালাক্সি হাসপাতালে এবং পরে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।

অভিযান শেষে মিজানের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা যায় পুরো ঘরময় ছোপ ছোপ রক্ত। রক্তের দাগ লেগে রয়েছে দেয়ালেও।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল রেজানুর রহমান খান রাত পৌনে ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে এক সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের জানান, আটক ব্যক্তির নাম জাহেদুর রহমান ওরফে বোমা মিজান। তাকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আগারগাঁও তালতলা থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মিজান জানায়, তার বাড়িতে বোমা রয়েছে। এরপর বোমা উদ্ধারের জন্য তার বাড়িতে এলে এ ঘটনা ঘটে।

রেজানুর রহমান জানান, মিজানের স্ত্রী বেরিয়ে আসার পর তার বাসা থেকে দু'টি গ্রেনেড, একটি অবিস্ফোরিত বোমা ও ২টি ম্যাগজিনসহ একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া কিছু জেহাদি বই-পুস্তকও পাওয়া যায় সেখানে।

তিনি বলেন, মিজানের দুই শিশু সন্তানই অক্ষত রয়েছে। উদ্ধারের সময় তাদের গায়ে যে রক্ত দেখা যায় তা তাদের মায়ের।

র‌্যাব কর্মকর্তা আরো জানান, মিজান জেএমবির একজন শীর্ষ পর্যায়ের বোমা বিশেষজ্ঞ। সে জেএমবির তাত্ত্বিক নেতা শায়খ আব্দুর রহমানের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলো এবং সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। ২০০৩ সালে যশোরের ঝিকরগাছা সীমান্তে মোটরসাইকেলে করে বিস্ফোরক বহনের সময় সে একবার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল। পরে ছাড়া পেয়েই আত্মগোপন করে মিজান।

পীরেরবাগের ওই বাড়িটির মালিক ব্যবসায়ী নিশাত মোহাম্মদ জানান, গত ১ এপ্রিল মিজান নিজেকে ইমরুল কায়েস ও ইলেকট্রিক মিস্ত্রি পরিচয় দিয়ে মাসিক সাড়ে তিন হাজার টাকায় ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেয়।