কপ২৬: এর পর কী

কয়লায় ‘ফাঁকিতে’ এবারের জলবায়ু সম্মেলন ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য বয়ে এনেছে হতাশা; নামমাত্র একটি চুক্তিতে সই করে প্রতিনিধিরা ফিরে গেছেন যার যার দেশে। জলবায়ু ঝুঁকিতে সামনের সারিতে থাকা বাংলাদেশ এখন কী করতে পারে? 

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2021, 06:32 PM
Updated : 30 Nov 2021, 07:01 PM

গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের স্বাধীন কারিগরি উপদেষ্টা প্যানেলের সদস্য ড. আহসান উদ্দিন আহমেদ বলছেন, বাংলাদেশের এখন প্রস্তুতিতে মনোযোগ দিতে হবে।

“আমাদের এখানে বড় প্রয়োজন দেশের ভেতরে অগ্রাধিকারের জায়গাগুলো চিহ্নিত করা। প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা ক্ষেত্রগুলোকে সুনির্দিষ্ট করা, সেখানে কীসের অভাব আছে তা এখনই আমলে নেওয়া এবং প্রত্যেকটা খাতের জন্যে একটি করে রোডম্যাপ তৈরি করা।”

জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) সদস্য ড. আহসান মনে করেন, এ বিষয়গুলো নিয়ে সংসদে আলোচনা হওয়া দরকার। আর ভবিষ্যতের রূপরেখাটাও আসতে হবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জায়গা থেকে।  

স্কটল্যান্ডের বৃহত্তম শহর গ্লাসগোতে ৩১ অক্টোবর থেকে ২০০ দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে শুরু হয় কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজের (কপ) ২৬তম আয়োজন। নির্ধারিত সময়ে খসড়া চুক্তি নিয়ে ঐকমত্য না হওয়ায় বাড়তি সময়ের আলোচনা শেষে ১৩ নভেম্বর রাতে ‘গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি’ সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।

এবারের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে কার্বন গ্যাসের নির্গমন যতটা কমানো দরকার, ততটা প্রতিশ্রুতি আসেনি। ঐকমত্য হয়নি অনেক কিছুতেই। শেষ পর্যন্ত যে চুক্তি হয়েছে, তাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দেশগুলো।

ড. আহসান উদ্দিন আহমেদ সম্মেলনের আগে এক সাক্ষাৎকারে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত আলাপকে নিছক আলাপ মনে করবার কোনো কারণ নেই। এটা একেবারেই দূতিয়ালি।

সেই দূতিয়ালি কতটা সফল হল, বাংলাদেশ আসলে কী পেল- সেসব বিষয় নিয়ে সম্মেলনের পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি।

আইপিসিসির তৃতীয় ও চতুর্থ মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রণয়নে যুক্ত থাকা আহসান আহমেদ সেন্টার ফর গ্লোবাল চেইঞ্জ (সিজিসি) এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্কসন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা এই গবেষক যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজেরও সঙ্গেও।  

তার ভাষায়, সম্মেলনে অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক জলবায়ু দূতিয়ালির একেবারেই প্রাথমিক ধাপ। এখন দায়িত্ব হচ্ছে ঘর গোছানো, রোডম্যাপ ধরে এগিয়ে যাওয়া। তাহলেই সম্মেলনে যাওয়াটা সফল হবে।

“যদি প্রস্তুতি থাকে, যদি জানি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত কোনগুলো, কোনে কোন প্রকল্পে আমি কীভাবে বিনিয়োগ করব এবং যদি দেখাতে পারি, সিদ্ধান্ত প্রণয়ন থেকে টাকা খরচের মাধ্যমে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সব জায়গায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়েছে, তবেই আন্তর্জাতিক জলবায়ু দূতিয়ালির মাধ্যমে বিনিয়োগ আনতে পারব।”

কেমন হল কপ২৬?

আহসান আহমেদ বলেন, এবারের সম্মেলন ছিল সারা পৃথিবীর আগ্রহের কেন্দ্রে। ২০০৯ সালের কোপেনহেগেন সম্মেলনের পর এবারের সম্মেলনের ব্যাপ্তি ও অংশগ্রহণ ছিল ‘সবচেয়ে বেশি’। সে কারণে প্রত্যাশাও অনেক বেশি ছিল।  মতপার্থক্য কমিয়ে আনতে পক্ষগুলোর মধ্যে স্নায়ুক্ষয়ী দর কষাকষি চলেছে দফায় দফায়। 

“আমরা বলছি না যে সুইস টিপে দিলাম, আগামীকালই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু পথরেখাটা যেন আগামীকালের জন্য তৈরি করা যায়।... স্বল্পোন্নত দেশ এবং ভুক্তভোগী দেশের পক্ষ আমাদের দিক থেকে এ প্রত্যাশাটা ছিল।

“অন্যদিকে পুরো ব্যাপারটা যেহেতু জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো নিয়ে এবং উন্নত দেশ এসব বেশি পোড়ায়, সমাধানের জন্য তাদের ভূমিকাও সবচেয়ে বেশি হবে। আবার সেসব দেশের বাস্তবতাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে।”

আহসান আহমেদ মনে করেন, কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও উন্নত দেশগুলোর পক্ষে ‘অনেক কিছু’ করা সম্ভব। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অনেক সমস্যার সমাধান ইতোমধ্যে তাদের হাতে রয়েছে। এখন তাদের যা করা দরকার, তার অনেকটাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপার।

“সমস্যা হল, জলবায়ু ইস্যুতে ৩০ বছর ধরে আলোচনা হলেও বিষয়টি এখনও অমীমাংসিত। বড় জনসংখ্যা নিয়ে যারা উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় ছিল, তাদের জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারও কিন্তু এই সময়ে ক্রমাগত বেড়েছে।”

গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের স্বাধীন কারিগরি উপদেষ্টা আহসান আহমেদ বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কার্বন গ্যাস ছড়ায় কয়লা। এবারের সম্মেলনের খসড়া চুক্তিতে কয়লার ব্যবহার বন্ধের অঙ্গীকারের বিষয়টিও ছিল।

“কিন্তু ভারতের চাপাচাপিতে শেষ মুহূর্তে নিষেধাজ্ঞার বদলে ক্রমান্বয়ে করা হবে- এ ধরনের একটা দুর্বল সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে একদিকে যেমন সবচেয়ে খারাপ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে এখনও একটা অস্পষ্টতা ঝুলিয়ে রাখা হল, সেই সুযোগ নিয়ে যারা আসলে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ঐতিহাসিকভাবে দায়ী, মনে যুক্তরাষ্ট্র, তারাও একটা সুযোগ পেয়ে গেল।”

বিষয়টি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে আহসান আহমেদ বলেন, “জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) একজন দীর্ঘকালীন সদস্য হিসেবে বলব- এটা বড় ধরনের ফাঁকি দেওয়া হল। স্বল্পোন্নত দেশ এবং সবচেয়ে ভুক্তভোগী দেশের মানুষ হতাশা ছাড়া এ সম্মেলন থেকে আর কিছু পায়নি।”

তার ভাষায়, অনেক আশা নিয়ে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে প্রটোকল সই করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ২১০০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক উষ্ণতা যেন প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না বাড়ে, সেই চেষ্টা করা হবে।

“কিন্তু এখন যত চেষ্টাই করি না কেন, বর্তমানের সুযোগ-সুবিধা ধরে এ পর্যন্ত যত সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা, তাতে এ শতাব্দীর শেষে ২.৮ ডিগ্রি থেকে ২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকবে। আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি থেকে এ সম্মেলনে সরে এলাম। এ কারণে এ সম্মেলনের আউটকামকে আমি বলছি হতাশাব্যঞ্জক।”

গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের স্বাধীন কারিগরি উপদেষ্টা প্যানেলের সদস্য ড. আহসান উদ্দিন আহমেদ।

বাংলাদেশ কী করবে?

ড. আহসান উদ্দিন আহমেদ বলছেন, এখন দরকার নতুন করে আলোচনা করা, তার ভিত্তিতে পরবর্তী কাজের রূপরেখা তৈরি করা, যাতে নিজেদের কাজটুকু অন্তত এগিয়ে নেওয়া যায়, ভবিষ্যতের দর কষাকষির সক্ষমতা তৈরি হয়।

“দেশে ফিরে এসে কাদের সঙ্গে বসেছি? কী পরিকল্পনা তুলে ধরেছি? পরিকল্পনায় কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে? সেগুলো কি চিহ্নিত করেছি? যদি ফলোআপ না থাকে, আমি ধরে নেব- এটা (সম্মেলনে) শুধুমাত্র যাওয়ার জন্যে যাওয়া।”

তার ভাষায়, সম্মেলনে অংশগ্রহণ বাংলাদেশের জন্য তখনই ‘কার্যকর’ বলা যাবে, যখন প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ফারাকটা নিজেরা বুঝে নেওয়া যাবে; কাঙ্ক্ষিত চুক্তি না হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে কিনা, নিজেদের সেই অংকটা করে নেওয়া যাবে; সে অনুযায়ী করণীয় নির্ধারণ হবে; সামনের দিনগুলোর স্পষ্ট রূপরেখা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো জনগণের সামনে উন্মুক্ত করবে।

“এটা পার্লামেন্টে আলোচিত হবে, এটুকু হয়েছে, এটুকু হয়নি, আমাদের এই এই পথে যেতে হবে...। ‘আপনারা তৈরি হন’- এই আহ্বানটা পার্লামেন্ট থেকে আসতে হবে। … তবেই আমি বুঝব যাওয়াটা সফল হয়েছে।”

এই গবেষকের ভাষায়, প্রতিটি সিদ্ধান্তেরই একটি ফলাফল রয়েছে। গ্লাসগোতে একটি চুক্তি হয়েছে, সেটা নিয়ে দেশে ফিরলেই কাজ শেষ হচ্ছে না। এই চুক্তির প্রভাব কী হবে, সেটা বুঝে নিতে হবে খাতওয়ারি বিশ্লেষণ করে। সেখানে বাংলাদেশের বিকল্প চিন্তাধারা কী হবে, সেটাও ঠিক করতে হবে।

“কোপেনহেনের শর্ত অনুযায়ী বছরে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর দেওয়ার কথা। তারা যে একেবারেই কোথাও অর্থায়ন করছে না- তা নয়। কিন্তু প্রায়োগিক দিক থেকে কোন খাতে অর্থায়নটা হলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে এবং কোন কোন প্রযুক্তি জরুরি ভিত্তিতে তাদের প্রয়োজন, সেটা ঠিকঠাক অনুসরণ করা হচ্ছে না।”

তিনি বলেন, জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় প্রতিনিধিত্ব হল আন্তর্জাতিক জলবায়ু দূতিয়ালির একেবারেই প্রাথমিক ধাপ। এটাই যেন চূড়ান্ত ধাপ না হয়, সেটাও খেয়াল রাখা দরকার।

“দায়িত্বটা হচ্ছে, ফিরে এসে আমি ঘর গোছাব। এ সম্মেলনের ঘোষণাপত্র থেকে জনগণের জন্যে যে ধরনের সিদ্ধান্ত এলে আরও ভালো হত, গ্যাপ পূরণের জন্যে কী করণীয়, কোথায় নির্গমন কমাতে হবে, কোথায় অভিযোজনের তৎপরতা বাড়াতে হবে, কোন উন্নয়নের সঙ্গে অভিযোজন জুড়ে দিতে হবে, প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে প্রত্যেকটা খাতে কাজগুলো করতে হবে।

“প্লেন থেকে নেমেছি, টিক দিয়েছি, দায়িত্ব শেষ- এমনটি যেন না হয়। দায়িত্ব যখন নিয়েছি, এটার ব্যাপারে বোঝাবুঝিটা কখনই থেমে থাকবে না, অব্যাহত থাকবে। কী করণীয়, অতিরিক্ত কী কী প্রযুক্তি লাগবে, অতিরিক্ত কী অর্থায়ন লাগবে, কোথায় অতিরিক্ত জনবল লাগবে- তা বিশ্লেষণ করতে জানাতে হবে।”

পাশাপাশি জলবায়ু তহবিলের অর্থ কোথায় কোথায় যাবে, কতটুকু অতিরিক্ত অর্থায়ন লাগবে- এসব বিষয় আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরতে দূতিয়ালিও চালিয়ে যেতে বলছেন তিনি। 

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন করে কীভাবে কাজটা করতে হবে, সেই ব্যাখ্যায় আহসান আহমেদ বলেন, এটা হতে হবে ‘মেজারেবল, রিপোর্টেবল এবং ভেরিফাইয়েবল’।

“অর্থাৎ কাজটা পরিমাপযোগ্য হতে হবে, উন্মুক্ত রাখতে হবে, এটার যথার্থতা যাতে যে কেউ দেখতে পারে। তবেই জলবায়ু তহবিল আহরণে আমাদের এ দূতিয়ালি ইতিবাচক ফলাফলের দিকে নিয়ে যেতে পারবে।”

পরের জলবায়ু সম্মেলনের জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়ার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “এটি চলমান প্রক্রিয়া। এটা অব্যাহত থাকতে হবে। আমরা যেন প্রস্তুতি নিয়ে যাই। এমন যেন না হয়, শেষ মুহূর্তের জোড়াতালির প্রস্তুতি।”

আরও পড়ুন