জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলো সম্মেলনে শিল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চাপ বজায় রাখলেও অনেক কিছুতে ঐকমত্য হয়নি; আদায় করা যায়নি আলোচিত অনেক প্রতিশ্রুতি।
শেষ পর্যন্ত কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিতে একটি চুক্তি নিয়ে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে শেষ হয় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন- কপ২৬।
প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির এমন ফারাকের মধ্যেও আশা ও সম্ভাবনা দেখছেন সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের একজন পরিবেশবিদ ও জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. আতিক রহমান।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের (বিসিএএস) এই নির্বাহী পরিচালকের মতে, এবার আলোচনাটা অন্তত এগিয়েছে, আগামীতে কী হবে তা নিজেদের ওপরই নির্ভর করবে। সেই কাজটা এখন করে দেখাতে হবে দ্রুততার সঙ্গে।
“ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো কালকের মধ্যেই সমস্যার সমাধান চায় বলে চুক্তি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে। কিন্তু সমস্যার সহজ সমাধান নেই।… এত মানুষকে বাঁচাতে হলে আশাবাদী হওয়া ছাড়া গতিও নেই।“
২০০৮ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ পদক ‘চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ’ পাওয়া ড. আতিক রহমান বলেন, এখন প্রস্তুতির সময়। জলবায়ু সম্মেলনে যে ‘চিৎকারটাৎ ওঠে, তা আসলে অ্যাডভোকেসি, সবাইকে নিয়ে তা করে যেতে হবে। সঙ্গে প্রস্তুতিও দেখাতে হবে।
প্রায় দুই সপ্তাহের সম্মেলন শেষে গ্লাসগো থেকে ড. আতিক ঢাকায় ফিরে বৃহস্পতিবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের অভিজ্ঞতা ও মতামত তুলে ধরেন।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেল-আইপিসিসি ২০০৭ সালে আল গোরের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পায়, ড. আতিক রহমান ছিলেন আইপিসিসির সঙ্গে।
এই জলবায়ু বিজ্ঞানী সবকটি জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেন এবং ‘কপ’ হওয়ার আগে তিনটি বার্ষিক সভা ও ইউএনএফসিসিসি তৈরির জন্য আট বছরে ১৩টি বৈঠকে অংশ নেন। ১৯৮৬ সাল থেকে বার্ষিক বৈঠকগুলোতে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।
নির্ধারিত সময়ে খসড়া চুক্তি নিয়ে ঐকমত্য তৈরি না হওয়ায় অতিরিক্ত আলোচনা শেষে ১৩ নভেম্বর শনিবার সন্ধ্যার পর ‘গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি’ সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।
কঠিন, তবুও সম্মতি
ুকপ২৬ এ এবার জোর প্রচেষ্টা ছিল বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রাক শিল্পায়ন যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে আটকে রাখতে কার্বন গ্যাসের নির্গমন যতটা কমানো দরকার, সেই অনুযায়ী প্রতিশ্রুতি আদায়ের। তবে অনেক দর কষাকষির পরও তা এবারের সম্মেলনে পাওয়া যায়নি।
ড. আতিক বলেন, “এবারের সম্মেলনের সবচেয়ে বড় আউটকাম হল- পৃথিবীর সবগুলো দেশ একমত হয়েছে, আমরা কার্বন নির্গমন ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখব। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হবে, ভালো থাকতে হলে। সেটা কঠিন। কিন্তু ২ ডিগ্রির নিচে রাখায় সম্মত হয়েছে।”
উন্নত দেশগুলো প্রতিবছর ১০০ বিলিয়িন ডলার গরিব দেশগুলোকে দিতে সম্মত হয়েছিল, যদিও তা দেওয়া শুরু হয়নি। এখন বলা হচ্ছে ১০০ বিলিয়ন ডলার যথেষ্ট নয়। আরও লাগবে প্রতি বছর। সেটা পাওয়াও কঠিন হবে বলে মনে করেন এই গবেষক।
আর্থিক সহায়তা ও সক্ষমতা কতটুকু
সম্মেলনে অংশ নেওয়া ছোটো দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর প্রধান দাবি মেনে ২০১৯ সালের পর্যায় থেকে জলবায়ু অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন ২০২৫ সালের মধ্যে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করতে ধনী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে চুক্তিতে।
তবে জলবায়ু তহবিলের প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড় বা জলবায়ুর ক্ষতি পোষাতে অর্থায়নের দাবিতে শিল্পোন্নত দেশগুলোর কোনো প্রতিশ্রুতি আদায় করা যায়নি।
সেই দর কষাকষি থেকে অর্থ আদায় করা যে কঠিন হবে, সে বিষয়টি তুলে ধরে ড. আতিক বলেন, “বহু আইন দেখাবে তারা, দেখাচ্ছে…। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো তো এখনই অর্থ চায়।… অর্থ কোত্থেকে আসবে, কারা দেবে- এ নিয়ে আলাপ আলোচনা কেবল শুরু হচ্ছে। এটা এত সহজ না।“
এ নিয়ে নিজেদের দক্ষতাও এখনও তৈরি হয়নি বলে মনে করেন এই জলবায়ু ‘নেগোশিয়েটর’।
“এখন একটা প্রশ্ন হচ্ছে, ১০০ বিলিয়ন ডলার। ধরুন, আমাকে কাল ১ বিলিয়ন ডলার দেওয়া হলো, তা খরচের জন্য ক্ষমতায়ন আমাদের হয়েছে কি না, তাও দেখতে হবে। আমার মতে, এখনও হয়নি। আমরা এগিয়েছি অনেক। টাকা পাওয়া খুবই কঠিন। কে দেবে, কেন দেবে? “
বাংলাদেশ সরকারের ‘পরিবেশ পদক ২০০৮’ পাওয়া এ জলবায়ু বিজ্ঞানীর মতে, অর্থ পেতে এমআরভি মেনে কাজ করতে হবে।
এর তিনটি মানদণ্ড হচ্ছে, এমআরভি-মেজারেবল (মাপতে পারতে হবে), রিপোর্টেবল (রিপোর্ট করতে পারতে হবে, লিখিতভাবে বলতে হবে কী করেছি) এবং ভেরিফাইয়েবল (তৃতীয় কোনো কোম্পানি যাচাই করবে, যা বলেছি ঠিক বলেছি, বিজ্ঞানসম্মতভাবে বলেছি)।
“আমরা যদি দেখতে পারি যে, আমাদের টাকা নেওয়ার ক্ষমতা আছে, খরচ করার ক্ষমতা রয়েছে, সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা আছে, তাহলে তারা টাকা দেবে। সেগুলোর জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়েছে কেবল। আমাদের দ্রুততার সঙ্গে এগোতে হবে।”
‘হতাশা থাকবে, সহজ সমাধানও নেই’
এবারের সম্মেলনে আসা চুক্তির সাফল্য যে প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই না, সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। শেষ পর্যন্ত যে চুক্তি হয়েছে, তাকে ‘রাজনৈতিক আপস’ আখ্যায়িত করেছেন তিনি।
সম্মেলনের মাঝপথেই সুইডিশ জলবায়ুকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ কপ২৬ ‘ব্যর্থ’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। চুক্তি নিয়ে ‘হতাশাজনক’ মন্তব্য এসেছে আরও অনেকের তরফ থেকে।
অবশ্য এ বিষয়ে ড. আতিকের মত ভিন্ন।
“এটা দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। চুক্তি নিয়ে এটা হচ্ছে আপনি যেভাবে বলেন। আমি মনে করি, আমরা এগিয়েছি আলোচনায়। আলোচনাটা এগিয়েছে, কাল কী হবে এটা আমাদের উপর নির্ভর করবে। আমাদের সমাজকে আমরা কিভাবে তৈরি করছি। আমার সরকারকে কীভাবে তৈরি করছি-এটাই এখন বিষয়।”
সহজে সমস্যার সমাধানের পথ না দেখেও অনেকে হতাশা প্রকাশ করতে পারেন বলে মনে করেন তিনি।
“অনেকে চুক্তি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করছেন তো, উনারা মনে করছেন কালকেই সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত। কিন্তু সমস্যার সহজ সমাধান নেই। টাকা ঢাললেই যে কাজ হয়ে যাবে তাও না। টাকাটা কে দেবে, কেন দেবে? আমাদের নিজস্ব ক্ষমতায়নে আরও এগিয়ে যেতে হবে।“
কূটনীতির সুফল থাকলেও ক্ষমতায়ন বাড়ানো দরকার
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জনে গরিব দেশগুলোকে প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান এ জলবায়ু বিজ্ঞানী।
তিনি বলেন, “এ সম্মেলনে আমরা এগিয়ে গেছি, আমরা স্বীকার করেছি। আমাদের সুবিধাটা বিশ্ব স্বীকার করেছে। সঠিক পথে এগোচ্ছি, আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। ক্যাপাসিটি বিল্ডিং করতে হবে, ইন্সটিটিউশনালাইজেশন করতে হবে। সরকারকে আরও সচেতন হতে হবে; এগিয়ে যেতে হবে।“
তার মতে, এবারের চুক্তি সবার জন্য সহায়ক। কিন্তু তার পরিস্ফুটন নির্ভর করছে ক্ষমতায়নের উপরে।
“চুক্তির ইমপ্লিমেন্টেশন, যেভাবে কাজটা করবে সেটা নির্ভর করবে আমাদের ক্ষমতায়নের উপরে। দ্রুতভাবে ক্ষমতায়ন বাড়াতে হবে। … বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গবেষণা বাড়াতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা করতে হবে। …আমাদের প্রধানমন্ত্রী যে পাঁচটি পয়েন্ট তুলে ধরেছেন সেটা দেশের জন্য শুধু নয়, বিশ্বের জন্য প্রয়োজন।“
দেশের জন্য কী?
সম্মেলন থেকে বাংলাদেশের পাওয়া না পাওয়ার বিষয়ে ড. আতিক রহমান বলেন, “সম্মেলন থেকে আমরা পেলাম যেটা- সেটা এগ্রিমেন্ট, পৃথিবীর জন্য। বাংলাদেশের জন্য কী হয়েছে সেটা বলা মুশকিল। কোনো দেশের জন্য বলা হয়নি। এ আলোচনা গ্রুপভিত্তিক, এখানে বড় দুটো গ্রুপ। দুদলের মধ্যে ঝগড়াটা হয়।”
সব কিছু মিলিয়ে সম্মেলন নিয়ে আশাবাদী থাকতে চান তিনি।
“আশাবাদী না হয়ে উপায় আছে? আমার এত সংখ্যক লোককে বাঁচাতে হলে আশাবাদী হওয়া ছাড়া গতি নেই। আমরা সঠিক পথেই আছি।”
আর আশা পূরণ হওয়ার জন্য ‘চিৎকারটাও’ জারি রাখতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “চিৎকার করাটাকে বলে অ্যাডভোকেসি; এটারও প্রয়োজন আছে। না কাঁদলে মাও দুধ দেয় না, অতএব আমাদের সে চিৎকার করে যেতে হবে।
“পৃথিবীতে আমাদের যারা বন্ধু রয়েছে, সে বন্ধু দেশগুলোও আমাদের হয়ে চিৎকার করে যাবে। সেটা একটা দিক, সেটা এগোচ্ছে। আরেকটা দিক হচ্ছে, সরকারের প্রস্তুতি দেখাতে হবে।“
তিনি বলেন, “আমরা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে টাকা আসবে না। দুর্নীতি কমাতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদের।”