বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে গত ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত এ নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ব্যাংকারসহ পাঁচ জনকে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আসার কথা জানিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।
গ্রেপ্তার পাঁচ জনের মধ্যে চার জন ব্যাংকার ও একজন আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগের টেকনিশিয়ান মোক্তারুজ্জামান রয়েল (২৬), যাকে প্রশ্ন ও উত্তরফাঁসের মূল হোতা বলে বলছেন গোয়েন্দারা।
গত ৬ থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এ পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের গোয়েন্দারা।
বুধবার বিকালে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার।
এ ঘটনায় আহসানউল্লাহ ইউনির্ভাসিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজির উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ ফজলে এলাহী তার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মীর জড়িত থাকার খবরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে ‘বিস্ময়’ প্রকাশ করেন।
তবে অভিযোগ ওঠায় ডিবির হাতে গ্রেপ্তার বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনিশয়ান রয়েলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
“ডিবির তদন্তের পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে,” যোগ করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হাফিজ আক্তার জানান, কয়েকটি সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পরীক্ষার্থীদের কাছে ৫-১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। চক্রটি প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁসের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে ৬০ কোটি টাকা।
“প্রশ্ন নিতে যারা টাকা দিয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়, তাদের ‘গোপন বুথে’ নিয়ে প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করানো হয়। এভাবে ৬০-৭০ ভাগ এমসিকিউ এর সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়েছে।“
টাকা নিয়ে প্রশ্নপত্র পেয়েছেন এমন দুই শতাধিক পরীক্ষার্থীর তালিকা পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানা গেছে। চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
"জড়িত সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তাদের পরিকল্পনায় প্রশ্নপত্র প্রণয়নসহ পরীক্ষা আয়োজনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আহসানউল্লাহ ইউনির্ভাসিটির আইসিটি বিভাগ থেকে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে।"
গত ৬ নভেম্বর বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন পাঁচটি ব্যাংকের ১ হাজার ৫১১টি ‘অফিসার ক্যাশ’ শুন্য পদের নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকে ১৮৩টি, জনতা ব্যাংকে ৫১৬টি, অগ্রণী ব্যাংকে ৫০০টি, রূপালী ব্যাংকে ৫টি এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে ৭টি পদ রয়েছে। বিকাল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র তৈরি ও পুরো পরীক্ষা সম্পাদনের দায়িত্বে ছিল আহসানউল্লাহ ইউনির্ভার্সিটি।
ডিবি প্রধান অভিযানের বর্ণনা দিয়ে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে কাজ করছিল ডিবির তেজগাঁও বিভাগ। গত ৫ নভেম্বর রাতে এ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের তথ্য আসার পর ছদ্মবেশে পরীক্ষার্থী সাজিয়ে পরীক্ষার দিন (৬ নভেম্বর) সকাল ৭টায় প্রশ্নপত্রসহ উত্তর পাওয়ার জন্য চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
“প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের একজন স্বপন অগ্রিম টাকা নিয়ে সেই পরীক্ষার্থীকে উত্তরপত্র বুঝিয়ে দেন। এরপর উত্তরপত্রসহ স্বপনকে হাতেনাতে আটক করা হয়।“
জিজ্ঞাসাবাদে তারা প্রশ্ন ও উত্তরপত্র সংগ্রহের কথা স্বীকার করেছে জানিয়ে হাফিজ আক্তার বলেন, "পরীক্ষার আগে চক্রের সদস্যরা রাজধানীর বাড্ডা, বসুন্ধরা, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, রূপনগর, মিরপুর, মাতুয়াইল, শেওড়াপাড়া, শেরেবাংলানগর, পল্লবী এলাকায় বুথ বসায়।
“যেখানে পরীক্ষার ৫ থেকে ৬ ঘন্টা আগে নিজস্ব লোকের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের ফাঁস করা প্রশ্ন ও উত্তরপত্র মুখস্থ করানো হয়। চক্রের সদস্যদের তত্ত্বাবাধনে প্রত্যেক বুথে ২০ থেকে ৩০ জন পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ করিয়ে কেন্দ্রে পাঠায়।"
গ্রেপ্তার শ্যামল গোয়েন্দারদের জানিয়েছেন, পরীক্ষার ৫ থেকে ৬ ঘন্টা আগেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে প্রায় ২ হাজার পরীক্ষার্থীদের মাঝে প্রশ্ন ও উত্তর সরবরাহ করা হয়। প্রত্যেকের কাছ থেকে বিভিন্ন ধাপে ৫ থেকে ১৫ লাখ পর্যন্ত টাকা নেওয়া হয়।
“এমসিকিউ পরীক্ষার আগে ২০ শতাংশ, লিখিত পরীক্ষার আগে আরও ২০ শতাংশ ও নিয়োগ পাবার পর বাকি ৬০ শতাংশ টাকা পরিশোধের শর্তে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে চুক্তি করে ডেকে নেওয়া হতো।"
এক প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, "এ প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে আহসান উল্লাহসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।"
তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রশ্নপত্র ফাঁসের তথ্য জানানো হয়েছে।
বুধবার রাতে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা পত্রিকা থেকে জেনেছি আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি থেকে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। আমরা চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানতে চেয়েছি। ১৪ নভেম্বরের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে। এরপর সিদ্ধান্ত নিব।”