অ্যানোরেক্সিয়া এবং বুলিমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী শাখার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সহপাঠী-শিক্ষকদের বুলিংয়ের (অসৌজন্য-অশালীন আচরণ, উপদ্রব, নির্যাতন, উৎপীড়ন) শিকার হয়েছিল কিনা, তা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।
Published : 22 Aug 2021, 03:11 PM
ঢাকার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে আগামী ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এ সংক্রান্ত এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘বুলিং’ থেকে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।
সেই সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বুলিং রোধে নীতিমালা তৈরি করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।
শিক্ষা সচিব, আইন সচিব, নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের সচিব, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
‘মোটা বলে সহপাঠী ও শিক্ষকের লাঞ্ছনার শিকার মৃত কিশোরের পরিবার যা বলছে’ শিরোনামে গত ৮ জুলাই বিবিসি নিউজ একটি সংবাদ প্রকাশ করে।
সেটি যুক্ত করে গত ১৬ অগাস্ট হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানভীর আহমেদ।
রোববার সে রিটের প্রাথমিক শুনানির পর রুলসহ আদেশ দেয় আদালত।
আদালতে রিটের পক্ষে তানভীর আহমেদ নিজেই শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।
আইনজীবী তানভীর আহমেদ বিডিনিউজটোন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বুলিং বন্ধে একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট। পরবর্তীতে একটি খসড়া নীতিমালাও তৈরি করা হয়। কিন্তু সেটি চূড়ান্ত করা হয়েছে কিনা তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বুলিং হচ্ছে এবং এর নির্মম শিকার হচেছ শিক্ষার্থীরা।”
এ আইনজীবী বলেন, “গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী শাখার ওই শিক্ষার্থী তার সহপাঠী-শিক্ষকদের দ্বারা বুলিংয়ের শিকার হয়েছিল। তার পরিবার এ অভিযোগ করেছে। সেটিই ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি রুল দিয়েছেন।”
ওই কিশোরের মৃত্যুর পর গত ৮ জুলাই বিবিসি বাংলা ‘মোটা বলে সহপাঠী ও শিক্ষকের লাঞ্ছনার শিকার মৃত কিশোরের পরিবার যা বলছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় অ্যানোরেক্সিয়া এবং বুলিমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে এক কিশোরের মৃত্যুর পর তার পরিবার অভিযোগ করেছে, স্কুলের সহপাঠী ও শিক্ষকদের বুলিংয়ের শিকার হবার ফলস্বরূপ এই ঘটনা ঘটেছে।
কিশোরের বাবা মো. ফজলুল করিম বলেছেন, তার ছেলের ওজন স্বাভাবিকের চাইতে বেশি হওয়ায় স্কুলে তাকে প্রায় নিয়মিতই বুলিং ও উপহাসের শিকার হতে হত।
প্রতিবেদনে কিশোরের পরিবারের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, গত ২৫ জুন রাতে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি করা হয়েছিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওই শিক্ষারথীকে। পরদিন রাত ১১টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়।
২০২০ সালের জুন-জুলাইতে ছেলেটির ওজন ছিল ৯৩ কেজি। এরপর জুলাই মাসের দিকে সে খাবার নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। ডিসেম্বরে ছেলেটির ওজন দাঁড়ায় ৬০ কেজি। পরিবার ভাবছিল স্বাভাবিক নিয়মে ওজন কমছে ছেলেটির। জানুয়ারির শেষ দিকে ছেলেটির শারীরিক কিছু পরিবর্তন নজরে আসে সবার।
তার পায়ের গোড়ালি ফুলে গিয়েছিল, তার স্বাভাবিক প্রাণচাঞ্চল্য হারিয়ে গিয়েছিল এবং সে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। ফেব্রুয়ারিতে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে ছেলেটি প্রথম জানায় সে ইন্টারনেট থেকে একটি জনপ্রিয় ডায়েট প্রোগ্রাম অনুসরণ করে ওজন কমাচ্ছিল। ওই সময়েই তার একটি মানসিক পরিবর্তনও হচ্ছিল।
এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে ছেলেটিকে একইসঙ্গে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ডায়েটিশিয়ান, সাইেকালজিস্ট এবং সাইক্রিয়াটিস্টের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা দেওয়া শুরু হয়। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, ছেলেটি অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা নামে একটি অসুখে ভুগছে।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য বিভাগ এনএইচএস’র বরাত দিয়ে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা আহার সংক্রান্ত একটি ব্যাধি, যা নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির মধ্যে মানসিক সমস্যাও তৈরি করে।
এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি না খেয়ে থেকে অথবা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম খেয়ে ওজন কমাতে চান, এবং ওজন বেড়ে যাওয়া নিয়ে ভীতিতে ভোগেন।
নিয়মিত চিকিৎসা এবং মনোবিদের সাহায্যে ছেলেটির ওজন কিছুটা বাড়লেও, শেষ পর্যন্ত জুন মাসের শেষদিকে সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। সেই প্রেক্ষাপটেই ২৫ জুন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ বাক্স রাখতে অভিমত ছিল হাই কোর্টের
বুলিংয়ের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা যাতে অভিযোগ জানাতে পারে সে জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ বাক্স রাখাতে দুই বছর আগে অভিমত দিয়েছিল হাই কোর্ট।
বুলিং প্রতিরোধে সরকারের করা খসড়া নীতিমালায় এ বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করতেও বলা হয়েছিল।
অভিযোগ বাক্স স্থাপন ও শিক্ষার্তীদের অভিযোগ বাক্সে অভিযোগ জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়াতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রচারণা চালাতেও বলেছিল উচ্চ আদালত।
বুলিং প্রতিরোধে করা খসড়া নীতিমালার বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদন দিলে ২০১৯ সালের ১০ জুলাই বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চ এ অভিমত দিয়েছিল।
সেই সঙ্গে এই নীতিমালা চূড়ান্ত করার বিষয়ে কী অগ্রগতি হয়েছে, তা ওই বছরের ২২ অক্টোবরের মধ্যে জানাতে নির্দেশ দিয়েছিল।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের ছাত্রী অরিত্রি অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় হাই কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর বুলিং ও শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধের উপায় নির্ণয়ে একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরিতে অতিরিক্ত শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দেয়।
কমিটি গঠন করে এক মাসের মধ্যে বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। পাশাপাশি অরিত্রী অধিকারী নামের ভিকারুননিসার ওই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করেও প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল কমিটিকে।
আদালতের ওই আদেশের ধারাবহিকতায় গঠিত কমিটি ২০১৯ সালের জুলাইয়ে একটি খসড়া নীতিমালা করে হাই কোর্টে দাখিল করে। সেটি চূড়ান্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে।