দক্ষিণখান: যেখানে বর্ষা মানেই দুর্ভোগ

নতুন কেউ এলাকায় এলে পয়ঃনিষ্কাশনের নালা ভেবে ভুল করতে পারেন; তবে স্থানীয় কাউকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলবেন, এটাই ঢাকার দক্ষিণখানের মাঝিবাড়ি রোড।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 June 2021, 07:37 PM
Updated : 22 June 2021, 07:37 PM

খুব বেশি ভারী বৃষ্টি গত কিছুদিনে ঢাকায় হয়নি। কিন্তু দক্ষিণখানের গাওয়াইরের মাঝিবাড়ি ও আশপাশের কয়েকটি এলাকার সড়ক মাসখানেক ধরেই এরকম পানিতে ডুবে আছে।  

ডুবন্ত এসব সড়কের কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমর ছুঁয়ে যায়। কাপড় বাঁচাতে স্থানীয় বাসিন্দারা চলাফেরা করছেন নৌকায়, অনেকে যাচ্ছেন রিকশায় করে।

বৃষ্টির পানি ঢুকে গেছে অনেক বহুতল বাড়ির নিচতলায়। পুরনো একতলা, আধাপাকা বাড়িগুলোর অবস্থা আরও করুণ। পানিতে রান্নাঘর, টয়লেট তলিয়ে গেছে। ফলে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বাসিন্দাদের।

না, হঠাৎ করে কোনো দুর্বপাক ঘটেনি। গত কয়েক বছর ধরেই বর্ষাকালে এমন সমস্যায় পড়তে হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। এ অবস্থায় এলাকা ছাড়ার কথা ভাবছেন ভাড়াটিয়াদের অনেকে।

রোববার গাওয়াইরের মাঝিবাড়ি রোড, ইয়াজ উদ্দিন রোড, ডাক্তার গলি, জমিদার গলি, নগরিয়া বাড়ি, চালাবন, স্কুল রোড, পেয়ারাবাগান, আনোয়ারা বাগ, চেয়ারম্যানপাড়া ছাড়াও মোল্লারটেক, দক্ষিণখান বাজার এলাকা ঘুরে দেখা গেল, অনেক সড়কেই পানি জমে আছে।

কারণ কী

এসব এলাকা পড়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৭, ৪৮ ও ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডে। এক সময় এসব এলাকা দক্ষিণখান ইউনিয়ন পরিষদের আওতায় ছিল।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গাওয়াইর, দক্ষিণখান, আশকোনো, প্রেমবাগান, মোল্লারটেক, আমতলাসহ পুরো এলাকার বৃষ্টির পানি আগে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হত। নালা, খাল, নিচু জমি হয়ে সেই পানি চলে যেত বালু নদীতে।

কিন্তু গত কয়েক বছরে নিচু এলাকাগুলো ভরাট করে আশিয়ান সিটি, বনরূপা আবাসিক এলাকা এবং যমুনা গ্রুপের একটি আবাসন প্রকল্প হয়েছে। ফলে বৃষ্টি হলে পানি যাওয়ার জায়গা থাকে না।

ইয়াজ উদ্দিন রোডের বাসিন্দা নূর জাহান বলেন, এক মাসের বেশি সময় ধরে তার বাসার নিচতলায় হাঁটু পানি। প্রতিদিন ওই পানি ডিঙিয়ে দক্ষিণখান সড়কে তার ফার্মেসিতে যেতে ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

“আমরা দোতলায় থাকি বলে রান্নাবান্নায় সমস্যা হয় না। কিন্তু রাস্তায় নামলেই পানি। ফার্মেসিতে যেতে হয় নৌকা বা রিকশায় করে। এইটুকু জায়গা পার করে দিতে ২০ টাকা করে নেয়। আমরা যেভাবে বেঁচে আছি এটাকে জীবন বলে না।”

ইয়াজউদ্দিন সড়কের বাসিন্দা আবদুল ওয়াহাব জানান, গত সাত-আট বছর ধরে প্রতি বর্ষায় পানি নিষ্কাশন নিয়ে এই সমস্যা পোহাতে হচ্ছে।

“বর্ষাকাল এলেই আমাদের দুর্ভোগ শুরু হয়। আমরা পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনোভাবে বেঁচে আছি। টয়লেট পানির নিচে, খাওয়াদাওয়ার জায়গা নাই। রান্না যে করব, চুলাও পানি নিচে চলে গেছে। রাস্তাঘাট সব পানির নিচে।

“আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি, এয়ারপোর্টের এত কাছে হয়েও দক্ষিণখানবাসী আমরা খুব কষ্টে আছি। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা যেন তিনি করে দেন।”

স্থানীয় বাসিন্দা আবদুস সালাম বললেন, দীর্ঘদিন ধরে চলা এ সমস্যার সমাধান চাইতে তারা জনপ্রতিনিধিদের কাছেও গিয়েছেন। কিন্তু লাভ হয়নি।

“মেয়র সাব, এমপি সাব, সাবেক চেয়ারম্যান সাব- তাদের শুধু পা ধরা বাকি আছে। আমরা শেষ হয়ে গেছি। ভাড়াটিয়ারা চলে যাচ্ছে, অথচ লাখ লাখ টাকা খরচ করে বাড়ি করা হয়েছে। আমার নিজেরও একই অবস্থা।”

ওই এলাকার বাসিন্দা বনানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সুজন জানান, ২০-২৫ দিন আগে সড়কে পানি কম ছিল, মোটরসাইকেল নিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু পানি বেড়ে যাওয়ায় মোটরসাইকেল এখন বাসায় রেখেই বের হতে হচ্ছে তাকে।

“মহামারীর কারণে স্কুল বন্ধ, বাচ্চারা এমনিতেই বাইরে বের হতে পারে না। আগে বাসার সামনে রাস্তায় খেলাধুলার সুযোগ ছিল, পানির জন্য তাও পারছে না।”

দায় কার

এ পরিস্থিতির জন্য অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং আবাসন প্রকল্পকে দুষলেন দক্ষিণখান ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই, এটা এক সমস্যা। আবার, খাল না থাকলেও নর্দান ইউনিভার্সিটি থেকে বরুয়া ব্রিজ পর্যন্ত নিচু হয়ে পানি নামার ব্যবস্থা ছিল আগে। নিচু জমি ভরাট করে আশিয়ান সিটি এবং যমুনা গ্রুপের দুটি প্রকল্প হয়েছে। ফলে পানি নামার কোনো সুযোগ নেই।”

তোফাজ্জল হোসেন বলেন, তিনি চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় আশকোনা থেকে আশিয়ান সিটির ভেতর দিয়ে লেকসিটি পর্যন্ত একটি পাইপলাইন করা হয়েছিল।

“সেই পাইপও ভরে গেছে। ফলে এলাকা থেকে পানি নামতে পারে না। জলাবদ্ধতা দূর করতে হলে বড় সব রাস্তায় বড় ডায়ার পাইপ বসিয়ে খাল পর্যন্ত পানি নিয়ে যেতে হবে। এই মুহূর্তে জরুরিভাবে আশিয়ান সিটির পাইপগুলো পরিষ্কার করা দরকার।”

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলামও নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলোতে নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকার বিষয়টিকে এই ভোগান্তির জন্য দায়ী করলেন ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যদি সেন্ট্রাল ড্রেনেজ সিস্টেম না থাকে, তাহলে পানিটা যাবে কোন দিক দিয়ে? আমরা বিভিন্ন জায়গায় টোটকা চিকিৎসা করে পানি নামাচ্ছি। ড্রেনেজ সিস্টেম নাই, কিন্তু শহর উঠে গেছে, এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।”

তিনি জানান, নতুন ওয়ার্ডগুলোর পানি নিষ্কাশন এবং রাস্তাঘাট উন্নয়নের একটি প্রকল্প একনেকে পাস হয়েছে। কিন্তু মহামারীর কারণে কাজ শুরু করা যায়নি।

“আশা করছি এবার আমরা কিছুটা হলেও পারব এবং নতুন এলাকার জন্য পর্যায়ক্রমে কাজ শুরু করব।”

প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি (নিকার) ২০১৭ সালের ৯ মে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে নতুন করে মোট ১৬টি ইউনিয়ন যুক্ত করার প্রস্তাব অনুমোদন করে, যার মধ্য দিয়ে ঢাকার দুই সিটির আয়তন বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়।

সে বছরের ২৮ জুন ঢাকা সিটির আয়তন বাড়িয়ে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। ২০২০ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নতুন যুক্ত ওয়ার্ডগুলোর দায়িত্ব পান কাউন্সিলররা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে যুক্ত বাড্ডা, ভাটারা, সাতারকুল, বেরাঈদ, ডুমনি, উত্তরখান, দক্ষিণখান ও হরিরামপুর ইউনিয়নকে ৩৭ থেকে ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হয়েছে।

ঢাকার পাশের এসব এলাকায় নগরায়ন কোনো পরিকল্পনা মেনে হয়নি। তার ফল ভোগ করছে এলাকার মানুষ।