এত নারী পাচার কীভাবে হল?

পাশের দেশের এক ভাইরাল ভিডিওর সূত্র ধরে বাংলাদেশে এখন আলোয় আসছে নারী পাচার, যৌনকর্মে বাধ্য করা এবং শারীরিক নিগ্রহের ভয়ঙ্কর সব বিবরণ; সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রশ্ন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকগোলাম মর্তুজাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 June 2021, 07:20 PM
Updated : 12 June 2021, 05:23 AM

মে মাসের শেষে ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও দুই দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে রীতিমত ঝাঁকুনি দিয়ে যায়।

এরপর বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তৎপর হয়, গ্রেপ্তার করা হয় কয়েকজনকে। পাচারকারীদের একটি বড় চক্রকেও চিহ্নিত করা হয়।

গ্রেপ্তারদের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, পাচারকারী চক্রটি এর মধ্যেই সহস্রাধিক নারীকে ভারতে পাচার করেছে।

মানবাধিকার ও পাচার ঠেকাতে কাজ করা বেরসকারি সংস্থাগুলোর প্রশ্ন: সরকারের আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী ও কয়েক স্তরের গোয়েন্দা নজরদারি এড়িয়ে এত নারী পাচার হয়ে গেল কী করে?

তাহলে কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনও এর সঙ্গে জড়িত? সমাজের প্রভাবশালী কেউ কী ওই চক্রকে মদদ দিচ্ছে?

এসব প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ সদরদপ্তর বলেছে, যে কোনো অপরাধের তথ্য পেলে তাৎক্ষণিকভাবে তারা ব্যবস্থা নেয়। তবে মানবপাচারের মতো অপরাধ ঠেকাতে হলে পুলিশের পাশাপাশি অন্য সব সংস্থাকেও আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে।

বেঙ্গালুরুতে ভাইরাল হওয়া ভিডিও থেকে নির্যাতনকারীদের চিহ্নিত করে তাদের ছবি প্রকাশ করেছিল আসাম পুলিশ

প্রথম সূত্র ভাইরাল ভিডিও, তারপর মামলা

মে মাসের শেষে এক তরুণীকে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের একটি ভিডিও ভাইরাল হলে প্রথম পদক্ষেপ নেয় ভারতের আসাম পুলিশ। ওই ভিডিও থেকে পাঁচ নিপীড়কের ছবি প্রকাশ করে তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য টুইটারে পুরস্কারের ঘোষণা দেয় তারা।

পরে জানা যায়, নির্যাতনে জড়িতরা আছে বেঙ্গালুরুতে। আসাম থেকে খবর পেয়ে বেঙ্গালুরুর পুলিশ ওই ভিডিওর সূত্র ধরে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে।

বেঙ্গালুরুর পুলিশের তরফ থেকে জানানো হয়, ২২ বছরের যে তরুণীকে বিবস্ত্র করে শারীরিক নির্যাতনের পর দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছিল, তিনি বাংলাদেশি। সেই সঙ্গে নির্যাতনকারীরাও বাংলাদেশি। পাচারের শিকার এক নারীকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করায় ওইভাবে শাস্তি দেওয়া হয় তাকে।

সেই ভিডিও নজরে এলে বাংলাদেশের পুলিশও তৎপর হয়। ঢাকার হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন সেই তরুণীর বাবা, যিনি ভেবেছিলেন, মেয়ে তার চাঁদপুরে শ্বশুরবাড়িতে রয়েছে।

সেই মামলায় রিফাদুল ইসলাম ওরফে হৃদয় বাবু নামে এক টিকটকারের নাম আসে, যাকে নারীপাচার চক্রের সমন্বয়কারী বলছে। ঢাকার মগবাজারের হৃদয় বাবুসহ আর যাদের সেই ভাইরাল ভিডিওতে দেখা গেছে, তাদের পরিচয়ও ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে থাকে।

এদিকে এ নিয়ে আলোচনা শুরুর আগেই ওই চক্রের হাত থেকে পালিয়ে গত ৭ মে সাতক্ষীরা হয়ে দেশে পৌঁছান আরেক কিশোরী। পুলিশ তার সন্ধান পাওয়ার পর গত ১ জুন হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার আইনে মামলা করেন তিনি।

টিকটক তারকা বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে তাকে ভারতে নিয়ে গিয়েছিলেন হৃদয় বাবু। কিন্তু সীমান্ত পার হওয়ার পরপরই শুরু হয় যৌন নিপীড়ন। প্রবল নির্যাতনের মুখে একদিনে ১৯ জনের যৌন চাহিদা মেটাতেও বাধ্য করা হয় মেয়েটিকে। ৭৭ দিন পর তিনি কৌশলে পালাতে সক্ষম হন।

ওই কিশোরীর মামলায় হৃদয় বাবুসহ মোট ১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ তাদের মধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। 

এ নিয়ে গত ২ জুন ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মগবাজারের বাসিন্দা হৃদয় বাবু একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের সমন্বয়ক। ওই চক্রটি সহস্রাধিক নারীকে ভারতে পাচার করেছে বলে পুলিশের ধারণা।

বেঙ্গালুরুর ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে পড়ার পর ভারতীয় পুলিশ যাদের গ্রেপ্তার করেছিল, তাদের মধ্যে হৃদয় বাবু একজন। বর্তমানে তিনি ভারতের কারাগারে আছেন।

এদিকে গত ১০ জুন হাতিরঝিল থানাতেই মানবপাচার আইনে আরেকটি মামলা করেছেন পোশাককর্মী এক তরুণী। তার অভিযোগ, তার স্বামী বাস কন্ডাক্টর জাহিদুল ইসলাম রনি ৪০ হাজার টাকায় তাকে পাচারকারীদের কাছে ‘বিক্রি করে’ দেন।

ভারতের একটি বৃদ্ধাশ্রমে মাসে ৩০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি দেওয়ার কথা বলে পাচারকারী চক্রটি তাকে চেন্নাইতে নিয়ে গিয়ে যৌনকর্মে বাধ্য করে। গত জানুয়ারি মাসে পাচার হয়ে যাওয়া ওই তরুণী গত মাসে কৌশলে দেশে ফিরতে সক্ষম হয়।

পাচারের পথ সাতক্ষীরা

দেশে ফিরে মামলা করতে সক্ষম হওয়া দুজনই তাদের এজাহারে বলেছেন, সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে তাদের পাচার করা হয়। তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন নারীকে একসঙ্গে দল বেঁধে ভারত সীমান্তের ওপারে নেওয়া হয়।

তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, সীমান্তের দুই পাশেই নারী পাচারের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ দালালচক্র রয়েছে। সীমান্তে পাচারের জন্য জড়ো করা নারীদের রাখতে ঘর, পরিবহনের জন্য মোটরসাইকেল রয়েছে দালালদের কাছে।

আর ভারতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দালালদের একটি অংশ তাদের ছবি তুলে ও কিছু তথ্য নিয়ে আধার কার্ডও তৈরি করে দেয়। এরপর তাদের উড়োজাহাজে করে অন্ন শহরে নেওয়া হয়। জোর করে বিবস্ত্র ছবি ও ভিডিও তুলে সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে জিম্মি করা হয় তাদের।

অবৈধভাবে ভারতে ঢোকা এই তরুণীদের পুলিশে ধরিয়ে জেল খাটানোরও ভয় দেখায় মানব পাচারকারীরা। ভারতের বেঙ্গালুরু, চেন্নাইসহ বিভিন্ন শহরে যেসব বাসা ও রেস্টহাউজে তাদের রাখা হয়েছিল, সেখানে আরও বাংলাদেশী তরুণীকে দেখার কথা মামলায় উল্লেখ করেছেন তারা।

হৃদয় বাবু, যিনি টিকটক হৃদয় নামে পরিচিত

কীভাবে সম্ভব হল?

দেশের ভেতরে পুলিশ, র‌্যাবসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী অপরাধ দমনে কাজ করছে। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও করছে নজরদারি। সীমান্তে পাহারায় রয়েছে বিজিবি।

সবার অগোচরে কী করে এত বিপুল সংখ্যক নারীকে পাচার করা সম্ভব হল সেই প্রশ্ন রেখে মানবাধিকারকর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মহাসচিব নূর খান বলেন, “ঢাকাকেন্দ্রিক পাঁচশ নারীকেও যদি পাচার করে থাকে ওরা, তাও এটা একটা ভয়াবহ ঘটনা, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর বিশাল ব্যর্থতা।

“আমাদের এত সংস্থা থাকার পরেও এতো ঘটনা নীরবে ঘটে গেছে, আমাদের চোখে পড়েনি। আমাদের চোখে তখনি পড়েছে, যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি ভাইরাল হয়েছে। তার মানে হল, আমাদের যে সংস্থা, সংগঠনগুলো এগুলো ঠেকাতে কাজ করছে বছর বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে, তাদের সমস্ত কিছুই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।”

নূর খান বলেন, “এই ব্যর্থতার দায়ভার তাদের নিতে হবে। সচেতনতা তৈরির কাজে দুর্বলতা থাকতে পারে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় দুর্বলতা থাকতে পারে। আর সরকারের যে অংশটি সেল গঠন করে মানব পাচার ঠেকানোর কাজ করছে এসব ঘটনা তাদের সীমাহীন ব্যর্থতাকেই প্রমাণ করে।”

এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, যেসব ঘটনা এখন জানা যাচ্ছে, সেগুলো আশপাশেই ঘটেছে। অথচ যাদের খবর রাখার কথা, তারা রাখেনি।

“আমরা তথ্য পাচ্ছি যে তারা ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় মেয়েদের নিয়ে পার্টি করেছে, সেখান থেকে রিক্রুট করা হয়েছে। দেশের অনেকগুলো জেলার ওপর দিয়ে এই মেয়েদের সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

“এখন খুঁজে দেখা দরকার এর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সমাজের শক্তিশালী অংশের কেউ যুক্ত আছেন কী না। তা না হলে নীরবে এত বিরাট ঘটনা ঘটতে পারে না।”

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবপাচার প্রতিরোধ মনিটরিং সেলের উপদেষ্টা সালমা আলী বলেন, মহামারীর মধ্যে ‘ঢিলেঢালা’ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগে অনেক মানুষ পাচার হয়ে গেছে।

“এসব চক্রের হোতারা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এখন সময় এসেছে জাল ফেলার মত করে এসব চক্রের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও এদের হোতাদের ধরার।”

সালমা আলী বলেন, এই পাচারকারী চক্রের সদস্যরা যেসব টিকটক ভিডিও তৈরি করেছে, সেসব ওই হাতিরঝিলে বা অন্য এলাকায় প্রকাশ্যেই করা হয়েছে।

“আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী কি এসব দেখেনি? ওই ভিডিওটা (নির্যাতনের) ভাইরাল হওয়ার পর তারা জানল?”

মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি বলেন, বিভিন্ন সময় ভারত থেকে ফেরা তরুণীদের কাছ থেকে তারা জেনেছেন, পাচারের সময় বিশেষ করে ভারতের অংশে তারা একাধিকবার বিভিন্ন বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন। পরে চক্রের সদস্যরা তাদের ছাড়িয়েও নিয়ে গেছেন।

“বিভিন্ন সময় মাদক চোরাচালানে যুক্ত হিসেবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম এসেছে। এই নারী পাচারের চক্রগুলোকে কারা পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, সেটা খুঁজে বের করা খুব জরুরি। শুধু চুনোপুঁটিগুলোকে ধরলে হবে না।”

পুলিশ কী বলছে?

মানব পাচার ঠেকাতে পুলিশ কী করছে তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল পুলিশ সদরে দপ্তরের কাছে।

তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল পুলিশের কাছে এসব মানব পাচারের বিষয়ে আগাম কোনো তথ্য ছিল কিনা, এত নারী পাচারের ঘটনাকে নজরদারির ব্যর্থতা হিসেবে পুলিশ সদরদপ্তর স্বীকার করে কিনা?

পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম) সোহেল রানা এর লিখিত জবাবে বলেন, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্রমবর্ধমান বিপুল সংখ্যক ইন্টারঅ্যাকশনস মনিটরিং করা একটি চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পুলিশে প্রাযুক্তিক সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে এবং হচ্ছে।

“পুলিশ ২৪/৭ মনিটরিং করছে। নানা প্রকার অপরাধে প্রতিনিয়ত অনেককে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। যে কোনো অপরাধের তথ্য পেলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ। লিবিয়াসহ অন্যান্য দেশে মানব পাচারের অভিযোগে সারাদেশে ব্যাপক সাড়াশি অভিযান পরিচালনা করেছে পুলিশ।

“তবে, যে সকল বাধা বা ধাপ পেরিয়ে মানবপাচারের মত অপরাধ সংঘটিত হয় পুলিশ হচ্ছে তার একটি৷ তাই, পুলিশের পাশাপাশি অন্য সকল অনুষঙ্গকেও একই সাথে অধিকতর সক্রিয় করতে হবে।”