সোমবার দুপুরে গাবতলী টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেল সারি সারি কাউন্টারগেুলো সব বন্ধ। সুনসান টার্মিনালের ভেতরে বাসগুলোও পড়ে আছে, কারও কোথায় যাওয়ার তাড়া নেই। কর্মীরা বেঞ্চে বসে মোবাইলে লুডু খেলছেন।
তবে টার্মিনাল ছেড়ে সামনে আমিনবাজার সেতুতেই দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। সেতুর হাঁটাপথ ধরে হাজারো মানুষের স্রোত; তারা ব্যাগ-বোঁচকা টেনে নিয়ে চলছেন ত্রস্ত পায়ে।
সেতু পেরোতেই শোনা গেল চিরচেনা সেই হাঁকডাক। ‘ঘাট তিনশ, পাটুরিয়া তিনশ’বলে সুর করে ডেকে চলেছেন কয়েকটি বাস ও লেগুনার সহকারীরা।
গাবতলীর দিকে দারুসসালাম থানার পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। সেতু পার হতেই একজনকেও দেখা গেল না।
সেতুর ওপরই তিন টনের ট্রাক থামিয়ে যাত্রী তুলছিলেন চালক ও সহকারী। যাবেন কোথায় জিজ্ঞেস করতেই সহকারী এগিয়ে এসে বললেন, ‘ঘাট একদাম দুইশ। আমার চাইতে কম আর পাইবেন না।’
ট্রাকের চালক আল ইমরান জানালেন, কুষ্টিয়া থেকে কাঁচামাল নিয়ে এসেছিলেন। পাটুরিয়া ঘাটে গিয়ে রাতের ফেরি ধরবেন। যে কয়জন যাত্রী তুলতে পারেন সেটাই লাভ।
আমিনবাজার সেতু পার হওয়ার পর সড়কের দুই পাশেই সারি সারি বাস, লেগুনা, কার, মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত রিকশা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।
লেগুনার শিশু সহকারী ডেকেই চলেছে, ‘আগে যামু আগে যামু, বইসা যান, তিনশ টাকায়। ‘ভাঙাচোরা যানটির চালক মো. ইয়াসিন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার হাতের সিগারেটটি শেষ হওয়ার আগেই গাড়ি ভরে গেল। যাত্রীরা তাড়া দিতে শুরু করলে সিগারেট ফেলে স্টিয়ারিং ধরলেন তিনি।
রাস্তার দুই পাশে রাজধানী, বৈশাখী, মৌমিতা, ঠিকানা পরিবহনের পাঁচটি বাস রাখা। সহকারীদের বেশিক্ষণ ডাকাডাকি করা লাগছে না। কয়েক মিনিটেই বাসগুলো ভরে যাচ্ছে। ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন পথে চলাচলকারী এসব বাসই এখন ঘরমুখো মানুষের বাহন হয়ে উঠেছে।
গাবতলী হয়ে দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে যাওয়া যায়।
ঘরমুখো মানুষ ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল এখন যে জনস্রোত তাদের বেশিরভাগের গন্তব্য কুষ্টিয়া, যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহসহ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা।
পরিবহন কর্মীরা জানালেন, উত্তরাঞ্চলের বাসগুলো ছেড়ে যাবে সন্ধ্যার পর বাইপাইল ও চন্দ্রা এলাকা থেকে। তখন আবার এই যানবাহনগুলো বাইপাইল ও চন্দ্রার দিকে চলাচল করবে।
ক্ষুব্ধ ফরিদ বলেন, ‘ঘাট পার হলি পরে সবই চলতিছে, সবাই বাড়ি যাতিছে। এইহানে খালি খালি এতো কষ্ট দিতেছে। টাকাও যাবে ম্যালাগুলান।’
আড়াই বছরের মেয়েকে নিয়ে ভিড়ের মধ্যে সেতু পার হলেন পোশাককর্মী মানিক ও শিমু দম্পতি। গরমের কারণে কোলের শিশুটির জামা খুলে খালিগা করে দিয়েছেন। তবুও বৈশাখের দুপুরের রোদ-গরমে শিশুটির নাভিশ্বাস।
এভাবে কষ্ট করে কেন বাড়ি যেতে হবে জানতে চাইলে মানিক বলেন, ‘সারা বছর কষ্ট করি। ঈদটা বাড়িত না করলে সবারই খারাপ লাগবে। এইজন্যি একটু কষ্ট হইলেও যাতিছি।’
ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর চালকেরা হাঁক দিচ্ছেন, ‘নবীনগর, বাইপাইল, চন্দ্রা’ বলে। আাশপাশের এলাকায় যাওয়ার জন্য মানুষ রিকশা ভাড়া করছেন। তবে ভাড়া মাত্রাতিরিক্ত বেশি।
দুই বোন একটা বস্তা নিয়ে হাঁটছিলেন। রিকশাগুলোর সামনে এসে তাঁরা বাইপাইল যাওয়ার জন্য রিকশা ঠিক করলেন চারশ টাকায়। তারা রংপুর যাবেন। গাড়ি সন্ধ্যায় ছাড়বে বলে জানানো হয়েছে। পরে যদি গাড়ি না পান সেজন্য আগেভাগেই রওনা হয়েছেন।
সেতুর গোড়ায় কিছু ভাঙাচোরা কার সারিবদ্ধভাবে রাখা। জনপ্রতি চারশ টাকা করে পাঁচজন যাত্রী নিয়ে পাটুরিয়া ঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছে গাড়িগুলো।
মামুনের কষ্ট
সঙ্গে থাকা তার ভাই জানালেন, তারা সাভারের হেমায়েতপুরে থাকেন। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মামুন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটা হাসপাতালে ভর্তি হন। সোমবার হাসপাতাল থেকে ছুটি দিলে তারা একটা সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে গাবতলী পর্যন্ত আসতে পারেন। এরপর চালক তাদের নামিয়ে দেন।
রিকশা পেয়েছিলেন, তবে এতো বেশি ভাড়া যে শেষ পর্যন্ত কষ্ট করে হলেও হেঁটেই সেতু পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেতু পার হয়ে কিছুদূর গিয়ে একটা রিকশায় ওঠে পরিবারটি।
আরও পড়ুন