বৃত্ত ভাঙা নারীরা

আড়াই মাসের মেয়েকে রেখেই চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন উম্মে নাজমিন ইসলাম। এক দশক পর পৃথিবী যখন মহামারীতে বিপর্যস্ত, তখন দুই বছরের ছেলেকে ঘরে রেখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড ইউনিটে মানুষের জীবন বাঁচানোর যুদ্ধে নামতে হয় তাকে।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2021, 06:03 PM
Updated : 7 March 2021, 06:03 PM

উম্মে নাজমিনের মতই অসংখ্য নারী সন্তান-সংসার সামলে এগিয়ে যাচ্ছেন। পরিবার ও সমাজের চ্যালেঞ্জের বৃত্ত ভেঙে কর্মজীবনে তারা সফলও হচ্ছেন।

পঞ্চগড়ের মেয়ে নাজমিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস করে ২৮তম বিসিএসের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ২০১০ সালে বড় মেয়ের আড়াই মাস বয়সে রেখে চাকরিতে যোগ দেন শেরপুরে।

তার চেয়েও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে এবার করোনাভাইরাসের মহামারীতে।

তবে পরিবারের সহযোগিতায় কঠিন সেই পরিস্থিতি সামলে তিনি ঠিকই নেমে পড়েন সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে।

কোভিড ইউনিটে এক সপ্তাহ ডিউটি, পরের দুই সপ্তাহ কোয়ারেন্টিনে থেকে তারপরের সপ্তাহে বাসায় ফিরতেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিদ্যা বিভাগের এই কনসালটেন্ট।

“খুব কঠিন সময় কেটেছে। আমি বাসায় এসে আইসোলেশনে থাকতাম, ছেলেটা যেহেতু ছোট, ও তো বুঝবে না। তাই ওর সামনে যেতাম না। লুকিয়ে থাকতাম। ও জানত- মা বাসায় নাই। এমন করে থাকতে হত, ও টের পেয়ে গেলে তো আলাদা থাকবে না।”

স্বামীর সহযোগিতার কারণেই সেই কঠিন কাজটি করতে পারছেন বলে জানান এখনও কোভিড ইউনিটে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া এই চিকিৎসক।

চিকিৎসক উম্মে নাজমিন ইসলাম

নাজমিন বলেন, “আমার জন্য ছেলেটা কান্নাকাটি করে। ওর বাবার অনেক কষ্ট হয়। রাতে ছেলের সাথে আমার স্বামী থাকেন। ডায়াপার বদলানো, ফিডার খাওয়ানো- সবকিছুই তিনি করেন। আমার শাশুড়িসহ বাসার সবাই সহযোগিতা না করলে কাজটা করতে পারতাম না।”

মায়েরা কর্মজীবনে সফল হলে সন্তানরা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে বেড়ে উঠে বলে মনে করেন উম্মে নাজমিন।

তিনি বলেন, “ওদের বড় হওয়াটা অন্যান্য বাচ্চার চাইতে একটু কঠিন হলেও পরবর্তীতে ওরা গর্ববোধ করে। আমি কোভিডের ডিউটি করায় আমার মেয়ে এটাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়। ওর কথাবার্তায় আমি বুঝতে পারি, ও অনেক গর্ববোধ করে। ও আমাকে প্রথম দিকে বলত- মা তুমি তো ফ্রন্টলাইনার, কোভিড ফাইটার। শুনতে খুব ভালো লাগে। প্রাপ্তি তো আসলে এগুলোই।”

খেলাধুলায় দেশের নারীদের এগিয়ে আসার পেছনে এক অনুপ্রেরণার নাম নারী জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক রুমানা আহমেদ। তবে আজকের অবস্থানে আসতে অনেক নারীর মতো বাধার বৃত্ত ভাঙতে হয়েছে তাকেও।

বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়ক রুমানা আহমেদ

ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল। এসএসসি পরীক্ষার পর পুরোদমে ক্রিকেটে ব্যস্ত হয়ে পড়া খুলনার রুমানা শত বাধাতেও খেলা ছাড়ার কথা চিন্তাও করেননি।

সেই সময়ের বাস্তবতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আগে তো ক্রিকেটের তেমন প্রচলন ছিল না। আর ড্রেসআপটা নিয়ে সবাই কথা বলত। মাঠের বাইরে থেকেও বাজে কথা বলত। পাড়া-প্রতিবেশীরাও খারাপভাবে নিয়েছিল বিষয়টা।”

তবে এই ক্রিকেটারের সাফল্যে পরিবারের সবাই খুশি, পরিবার থেকেই এখন সবচেয়ে বেশি সমর্থন পান।

ক্রিকেটে নারীরা ভালো করলেও পুরুষ ক্রিকেট দলের মত সুযোগ-সুবিধা পেতে আরও চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়ক। সেজন্য তৃণমূল পর্যায়ে নারীদের ক্রিকেটে আরও বেশি নজর দেওয়ার তাগিদ তার।

“সত্যিকার অর্থে আমাদের ওই পর্যায়টা আসেনি। তারপরও আমাদের প্রতি আগে যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, সেটা বদলেছে। সবাই এখন আমাদের ভালো করানোর চিন্তাটাই করছে। আমাদের জাতীয় টিমে যে সুযোগ-সুবিধাগুলো দেওয়া হয়, জেলা বা বিভাগ পর্যায়েও সেটা দেওয়া দরকার। তাহলেই দেশের নারী ক্রিকেটের উন্নতি হবে।”

নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির ইংরেজি সাহিত্যের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রুমানা মনে করেন, চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার লড়াই জোরদার করতে হবে নারীদের।

২০১৫ সালে প্রথমবার ট্রাফিক পুলিশে যে ২৮ জন নারী সার্জেন্ট যোগ দিয়েছিলেন, তাদের একজন শারমিন আক্তার জাহান রিপা।

বর্তমানে রমনা জোনের মগবাজার থেকে কাকরাইল পর্যন্ত এলাকায় ট্রাফিক সার্জেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

চাকরিতে চ্যালেঞ্জ অনেক, এটা জেনেই ইডেন কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর রিপা এসেছিলেন ট্রাফিক পুলিশে।

“সব পেশাতেই তো নারীরা যাচ্ছে। কিন্তু এ পেশায় কেউ আসেনি। শুধু সেটাই না, এ পেশাটা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। আমাদের নারী তো এভারেস্টও জয় করে ফেলল। তাহলে আমরা কেন পিছিয়ে থাকব? এরকম একটা চিন্তা থেকেই এ পেশায় আসা।”

নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই তাকে কাজ করে যেতে হচ্ছে। এমনকি সাপ্তাহিক কোনো ছুটিও পান না।

ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট শারমিন আক্তার জাহান রিপা

রিপা বলেন, “বিরূপ আবহাওয়াটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ মেয়েদের প্রখর রোদ বা বৃষ্টি এগুলো মেনে নিতে একটু কষ্ট হয়ে যায়। সেটা মেনেই কাজ করতে হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা সেটা হচ্ছে, টয়লেটের সমস্যা। সব জায়গায় ওয়াশরুম পাওয়া যায় না। আমাদের ওয়াটার সাপ্লাইটাও সব জায়গায় অ্যাভেইলেবল না। এটাও একটা বড় সমস্যা।”

তিন বছরের সন্তানের মা রিপা ভোগান্তিতে রয়েছেন বেবিকেয়ার না থাকার কারণেও। দেশে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের যথাযথ সুবিধা থাকলে নারীরা আরও বেশি এগিয়ে যেত বলে মনে করেন এই পুলিশ সার্জেন্ট।

“যদি একটা ডে-কেয়ার থাকত, তাহলে আমার টেনশনটা থাকত না। আর ঢাকা শহরে একটা বাচ্চাকে মেইনটেইন করা কষ্টকর।”

ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার স্বামী চাকরির কারণে গাজীপুরে থাকায় সন্তান নিয়ে বিপদ আরও বেড়েছে রিপার।

তিনি বলেন, “একেক সময় একেক সিস্টেম করে বাচ্চাকে রেখে যেতে হয়। খুবই কষ্টকর। এখন সবাই ব্যস্ত। আমাকে যে আলাদা করে সময় দিবে, এমন মানুষ তো নাই। সবাই কোনো না কোনোভাবে ব্যস্ত। এই কারণেই বেবি কেয়ার থাকলে সবার জন্য ভালো হত।”

পরিবারের বাধা কাটিয়ে উদ্যোক্তা হওয়া সানজিদা সালমা পলি এখন আরও অনেক নারী উদ্যোক্তা তৈরি করছেন। ১৯৯২ সাল থেকে কাজ শুরু করা পলি মনে করেন, পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নারীদের অনুকূলে আসছে।

“আমার পরিবার রক্ষণশীল ও স্বচ্ছল থাকায় আমাকে এ পেশায় আসতে দিতে চায়নি। কিন্তু এখনকার অনেক পরিবারকেই দেখি বেশ সহযোগিতা করে মেয়েদের। তারা এগিয়েও আসছে। আমরা খুব কঠিন অবস্থা সামলে উঠে এসেছি। কিন্তু এখন সরকার কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে, ভাতা দিচ্ছে। আবার আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।”

উদ্যোক্তা সানজিদা সালমা পলি

বরিশালের রূপাতলীতে ‘শিল্প কুটির’ তার ‘শোরুম’। কাপড়, জুতা, ব্যাগ, শোপিস, অলঙ্কার, কেক আর নানা পদের ডের্জাট খাবার তৈরি করে তার প্রতিষ্ঠান। পলি বেকারি, রান্না, বিউটি পার্লারের কাজ ও টেইলারিংয়ে প্রশিক্ষণও দেন।

মহামারীর কারণে ২৩ মার্চ থেকে প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হওয়ায় বেশ ক্ষতির মুখে পড়েছেন তিনি। সেই ধাক্কা সামলে উঠার লড়াই করছেন এখন।

পলি বলেন, “আমার স্থায়ী কর্মীদের বেতন দিতে হয়েছে, তাদের তো বাদ দিতে পারিনি। সাড়ে ৩৩ হাজার টাকা ভাড়া। এটা তো দিতেই হয়েছে। করোনার কারণে ১৮ লাখ টাকার লোকসান হয়েছে আমার।

“মানুষের জীবনে বাধা-বিপত্তি আসবেই। এখান থেকেই শিক্ষা নিতে হবে যে, নতুন সূর্য উঠবেই। সেই প্রত্যয়েই নারীদের এগিয়ে যেতে হবে।”

নারীনেত্রী খুশি কবির মনে করেন, নারীরা এখন বিভিন্ন পেশায় যোগ দিচ্ছেন, তারা বের হয়ে আসছেন, নেতৃত্বে আসছেন।

চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে নারীদের এই এগিয়ে যাওয়াকে স্বাধীনতার সুর্বণ জয়ন্তীতে বড় অর্জন হিসেবে দেখছেন তিনি।

দেশের বড়ু দুই রাজনৈতিক দলের প্রধান নারী হলেও নেতৃত্বে নারীদের আরও বেশি এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

“রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে কিন্তু পুরুষের সংখ্যাই বেশি। নারীদের এখানে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। শুধু রাজনীতি নয়, কর্মক্ষেত্র, রাষ্ট্রীয় কাজে নারীদের বেশি সংখ্যায় নিয়োজিত হওয়া প্রয়োজন।”

গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে নারীরা দায়িত্বের সাথে কাজ করছেন মন্তব্য করে খুশি কবির বলেন, “বিভিন্ন পেশায় যখন নারীরা আসবেন, তখন এমনিতেই নারীদের ব্যাপারে মানুষের ধারণা বদলে যাবে।”

কারও কথায় পিছিয়ে না গিয়ে নারীকে নিজের প্রতি আস্থা ও আত্মবিশ্বাস রেখে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ তার।