নারী নির্যাতন কমছে না কেন?

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নানা তৎপরতার পরও নারীকে এখনও প্রতিকূল পরিবেশে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। বরং করোনাভাইরাস মহামারীর পরিবর্তিত বাস্তবতায় নারীর প্রতি আরও বেশি সহিংসতার তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছেন সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Nov 2020, 06:21 AM
Updated : 25 Nov 2020, 06:21 AM

অধিকার কর্মীরা মনে করছেন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ক্ষমতা কাঠামো, শিক্ষা ব্যবস্থা ও আইনী কাঠামোতে সামগ্রিক পরিবর্তন আনতে হবে।

নির্যাতনের শিকার হয়ে নারী ও শিশুদের সেবা গ্রহণের সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছরই দেশে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে।

নির্যাতনের শিকার নারীদের সহায়তায় সরকারের জাতীয় হেল্পলাইন ‘১০৯’ এ চলতি বছরের অগাস্ট পর্যন্ত নয় লাখ তিন হাজার ৮৩০ জন নারী ও শিশু সহায়তা নিয়েছেন।

২০১৮ সালে ছয় লাখ ৫০ হাজার এবং ২০১৯ সালে ১৮ লাখ ১১ হাজার নারী ও শিশু চিকিৎসা সেবা, কাউন্সেলিং, পুলিশের সহযোগিতা, আইনী ও অন্যান্য সহযোগিতা নিয়েছেন।

আর ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেলে জুলাই পর্যন্ত নির্যাতনের শিকার ৪২ হাজার ৮৪৩ জন নারী ও শিশু চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৮৪২ জন যৌন নির্যাতন ও ২৮ হাজার ৪৯৪ জন শারীরিক নির্যাতনের শিকার।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্ধযুগে সবচেয়ে বেশি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২০১৯ সালে। গত বছর দেশে এক হাজার ৩৭০টি ধর্ষণ, ২৩৭টি গণধর্ষণসহ চার হাজার ৬২২টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।

এছাড়া চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত দুই হাজার ৭১১টি নির্যাতনের তথ্য পেয়েছে মহিলা পরিষদ। এর মধ্যে গত মাসে ১৭১টি ধর্ষণ, ৪৪টি গণধর্ষণসহ সবচেয়ে বেশি ৪৩৬টি নির্যাতনের ঘটনা এসেছে।

মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতন বেড়ে গেলেও করোনাভাইরাসের কারণে তথ্য প্রবাহে বিঘ্ন ঘটায় প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না।

“পত্রিকায় যে তথ্যগুলো পাচ্ছি, সে তথ্যগুলোই আমরা দিচ্ছি। কিন্তু গণমাধ্যমে সব তথ্য তো উঠে আসছে না। বিশেষ করে লকডাউনে খুব কম রিপোর্ট হয়েছে। তবে আমরা যারা এসব নিয়ে কাজ করছি, তারা দেখছি ধর্ষণসহ অন্যান্য নির্যাতনের ঘটনা আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে গেছে।”

এই বাস্তবতায় এবার আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালিত হচ্ছে। নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে বুধবার থেকে আগামী ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পর্যন্ত ১৬ দিনের আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষও পালিত হবে।

নির্যাতন কেন বাড়ছে?

সরকারের মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রাম অন ভায়োলেন্স এগেইনস্ট ওমেন এর প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেনও মনে করেন, নারীর প্রতি সহিংসতা সাম্প্রতিক সময়ে বেশি ঘটছে।

তার মতে, মহামারীতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসায় মানুষের মধ্যে যে অস্থিরতা কাজ করছে, সেটি নারী নির্যাতন বাড়াচ্ছে।

“মানুষের মধ্যে এখন এনগেজমেন্ট কমে গেছে, ফলে তারা এক ধরনের চাপ ও অনিশ্চয়তায় আছে। আবার আয়ও কমে গেছে। পুরুষের বাসার বাইরের ব্যস্ততা কমে এসেছে, ফলে পারিবারিক নির্যাতন হচ্ছে।”

আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে বুধবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট’র সমাবেশ। ছবি: নয়ন কুমার

একই কথা বলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের দায়িত্বে থাকা সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন।

“পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে গেছে, এ তথ্যগুলো আমরা পাচ্ছি। যৌন হয়রানি, ধর্ষণের ঘটনাগুলো সাম্প্রতিক সময়ে বেশি ঘটছে।”

তবে নির্যাতনের যেসব ঘটনা সামনে আসছে, পরিস্থিতি এর চেয়েও নাজুক বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপার্সন খন্দকার ফারজানা রহমান।

“অনেক ঘটনাই আমাদের সামনে আসছে না। পারিবারিক সহিংসতার সব ঘটনাগুলো আমরা জানতে পারছি না।”

নির্যাতনের মামলাগুলোর ‘ঠিকমত বিচার না হওয়ার’ কারণেই নারীরা বেশি সহিংসতার শিকার হচ্ছে বলে মনে করেন অপরাধ বিশ্লেষক ফারজানা রহমান।

তিনি বলেন, “পারিবারিক সহিংসতা বা নির্যাতন ঘরের মধ্যে হচ্ছে। আপনি তার বিরুদ্ধে মামলা করবেন, আবার একসাথে ঘরেই থাকবেন; সেটা তো সম্ভব না। সেই ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে মামলা খুব কম হয়। আবার বাধ্য হয়েই মামলাগুলো তুলে নেয় অনেকেই। একজন পুরুষ যখন ধর্ষণ করে, সে যদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার কাছাকাছি কোন ব্যক্তি হয়; তাহলে আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বের হয়ে যায়। অপরাধীর যখন শাস্তি হবে না তখন এটা তাদের জন্য প্রণোদনা।”

“নারীদের ক্ষমতায়ন যখন বাড়ছে, একই সাথে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও যখন নিশ্চিত হচ্ছে; তখন নারীরা মুখ বুজে সহ্য না করায় পারিবারিক সহিংসতা হচ্ছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও স্পিকার নারী, এরপরও অর্থনীতি ও রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ এখনও খুবই সীমিত। পুরুষতান্ত্রিকতা বা একজন নারী পুরুষের সমান না- এই চিন্তাভাবনাগুলোও নারীর প্রতি সহিংসতার কারণ।”

প্রতিরোধ কোন পথে?

নারী নির্যাতন বন্ধে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা দরকার মনে করেন ফারজানা রহমান।

তিনি বলেন, “স্কুলগুলোতে সেক্স এডুকেশন সম্পর্কে কোনো শিক্ষা দেওয়া হয় না। আমাদের বাবা-মায়েদেরও সেই মানসিকতা নাই যে, এই শিক্ষাটা দিবে। বাইরের দেশগুলোতে এই বিষয়গুলো পাঠ্যক্রমের অংশ, অথচ আমাদের দেশে তা নেই। এই কারণে ছেলেমেয়েরা অল্প বয়সে পর্নোগ্রাফিতে ঝুঁকে পড়ে। নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানির বিষয়গুলো পুরুষদের মধ্যে চলে আসে। যথাযথ শিক্ষাটা খুব জরুরি।”

নারীর প্রতি সংহিসতা কমাতে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় ধাক্কা দিতে হবে বলে মনে করেন মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী।

“ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো যারা ঘটাচ্ছে, তারা এক ধরণের ক্ষমতা বলয়ের মধ্যে আছে। এ নিয়ে এতো প্রতিবাদ, লেখালেখি হচ্ছে; তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না। নয়ন বন্ডের মত যারা অপরাধ করছে, কিশোর বয়সে; তাদের কোনো সংশোধন হচ্ছে না। যেসব কিশোররা অপরাধের সংস্পর্শে আসছে, তাদের ভালো করার বিষয়টি সংশোধন কেন্দ্রে থাকার কথা; কিন্তু সেখানে এটা নাই।”

বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়িয়ে তুলছে বলে মনে করছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক নীনা গোস্বামী। এই আইনজীবী মনে করেন, অপরাধ কমিয়ে আনতে আইন ও ব্যবস্থাপনার সংস্কার প্রয়োজন।

“যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে রায় হয়। মামলারগুলোর চার্জশিট তৈরি হয়নি কেন, তদন্ত হয়নি কেন- এ বিষয়গুলো একটা মেকানিজমের মধ্যে অনবরত মনিটরিংয়ে রাখা দরকার।”

তবে নারী নির্যাতন কমিয়ে আনতে বিভিন্ন পর্যায় থেকে কাজ করা হচ্ছে বলে দাবি মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রাম অন ভায়োলেন্স এগেইনস্ট ওমেন এর প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেনের। তিনি জানান, নির্যাতিতদের দ্রুত সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার।

“আমরা চেষ্টা করব অতিদ্রুত ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা ও আইনি সহায়তা দেওয়ার। পুরো দেশে আমাদের নেটওয়ার্ক রয়েছে। আমরা চেষ্টা করি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, এনজিও, সুশীল সমাজ- সবার সাথে সমন্বয় করে দ্রুত সেবা দেওয়ার।

“সাক্ষী অনুপস্থিতি ও মামলার জটের কারণে অনেকসময় বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হয়। সরকার চেষ্টা করছে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া তরান্বিত করতে” বলেন তিনি।

আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচী

বুধবার সকাল ১১টায় শিশু একাডেমী মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা।

এদিন নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নয় দফা দাবিতে ‘আমরাই পারি’ জোট মানববন্ধনের আয়োজন করেছে। পরে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে দাবিগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিবে সংগঠনটি।

এছাড়াও দেশে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো দিবসটি আয়োজনে নানা কর্মসূচী নিয়েছে।