গ্রাহকের ‘অজান্তে’ কোটি কোটি টাকা ঋণ, ব্যাংক কর্মকর্তা উধাও

বেসরকারি প্রিমিয়ার ব্যাংকের রোকেয়া সরণির শ্যাওড়াপাড়া শাখার ডজনখানেক গ্রাহকের অজান্তে কয়েক কোটি টাকা ঋণ তোলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন এক ব্যাংক কর্মকর্তা পালিয়ে গেছেন।

লিটন হায়দার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Oct 2020, 05:48 PM
Updated : 31 Oct 2020, 06:41 PM

ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ তদন্তেও (অডিট) কর্মকর্তাদের অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পেয়ে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় ব্যাংকের ওই শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক ফেরদৌস আলম এবং জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা ও ক্রেডিট ইনচার্জ জুলফিকার আলীর বিরুদ্ধে প্রায় ১২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।

এদের মধ্যে জুলফিকার গত ১৫ অক্টোবর ব্যাংকের ওই শাখায় অডিট চলাকালে পালিয়ে গেছেন জানিয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাফরুল থানার এসআই আরিফ উদ্দিন বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। জুলফিকারকে ধরতে পারলে জালিয়াতির পুরো চিত্র উদঘাটন করা যাবে।

ব্যাংকটির গ্রাহক নাসির উদ্দীন, আবদুস সালাম, মনিরুল ইসলাম, আব্দুল কাইয়ূম, মো. হেলাল উদ্দিন, দুলাল আহমেদ, লিটন আলী, মাহমুদ হাসান পল্টু, শেখ মো. সোহেল, আমিনুল ইসলাম ও মো. এনামুল হক তাদের অজান্তে অর্ধ কোটি থেকে পৌনে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন মোটা অংকের ঋণ তোলার কথা জানিয়েছেন।

এদের মধ্যে ব্যবসায়ী নাসির উদ্দীন জানান, ফ্ল্যাট কেনার জন্য একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়পত্র না দেওয়ায় খোঁজ নিয়ে তিনি তার নিয়মিত লেনদেনকারী প্রিমিয়ার ব্যাংকে এই ঋণের কথা জানতে পারেন।

পরে ব্যাংকের ওই শাখায় গিয়ে বিষয়টি জানালে কর্মকর্তারা কোনো ঋণ নেই বলে ছাড়পত্র দেন। এরপরেও বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ আছে বলে জানালে তিনি ব্যাংকে অভিযোগ করেন। অন্যরাও তার মতো অভিযোগ করলে প্রিমিয়ার ব্যাংকের বেগম রোকেয়া সরণি শাখায় ব্যাংকের কেন্দ্রীয় অডিট কমিটি তদন্ত শুরু করে।

এরপর প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট এইচআরের প্রধান কাওসার আলম মজুমদার বাদী হয়ে জুলফিকার আলী (৪০) ও ফেরদৌস আলমের (৫৯) বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় ওই মামলা দায়ের করেন।

মামলায় বলা হয়, প্রিমিয়ার ব্যাংকের নিরীক্ষা ও অডিট বিভাগ গত ১৫ অক্টোবর ব্যাংকের রোকেয়া সরণি শাখায় নিয়মিত অডিট করতে যান। অডিট কমিটির সদস্যরা এই শাখায় রাখা বিভিন্ন গ্রাহকের এফডিআর এবং ডাবল বেনিফিট হিসাবের নথি, ফরম ও রিসিপ্ট খুঁজে না পেয়ে জুলফিকার আলীর কাছে চান।

জুলফিকার খোঁজাখুজির ফাঁকে এফডিআর ও ডাবল বেনিফিট স্কিমের মূল কাগজপত্র নিয়ে হঠাৎ উধাও হয়ে যান। তাকে খোঁজাখুজি করে না পেয়ে প্রাথমিক খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এফডিআর ও ডাবল বেনিফিটের বিভিন্ন হিসাবের বিপরীতে ১১ কোটি ৯০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

জুলফিকার আলী ও ফেরদৌস আলম ছাড়াও ব্যাংকের এই শাখার আরও কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী এই কেলেঙ্কারিতে জড়িত বলে এজাহারে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

এদিকে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সন্দেহভাজন আরও ছয়জনকে ব্যাংকের ওই শাখা থেকে সরিয়ে প্রধান কার্যালয়ে ওএসডি করে রেখেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বর্তমানে ব্যাংকটির ওই শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক শাহরিয়ার কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনও তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হলে জালিয়াতিতে আর কারা কারা জড়িত, মোট কত টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে এবং কারা কারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে বিষয়ে স্পষ্টভাবে জানা যাবে।”

প্রিমিয়ার ব্যাংকের রোকেয়া সরণি শাখার জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা ও ক্রেডিট ইনচার্জ জুলফিকার আলী, এই জালিয়াতির জন্য তাকেই সন্দেহ করা হচ্ছে।

ক্ষতিগ্রস্ত নাসির উদ্দীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যাংকে আমার কোনো ঋণ নেই। যা ছিল তা শোধ করে ছাড়পত্রও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু হিসাবে প্রায় আড়াই কোটি টাকা ঋণ দেখানো হচ্ছে, যা অবিশ্বাস্য।”

আমিনুল ইসলাম নামের আরেক গ্রাহক বলেন, তার নামে ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা ঋণ নেওয়ার হয়েছে বলে জানানো হচ্ছে।

“আমি কিছুই জানি না। কীভাবে আমার নামে এই ঋণ হল বুঝতে পারছি না। কোটি টাকা কখনোই দেখিনি। আমার এখন কী হবে ভাই, রক্ষা পাবো তো?” 

তার মতো একই কথা বলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মাহমুদ হাসান পল্টু। তিনি বলেন, তার নামেও ৫৮ লাখ টাকা ঋণ হয়েছে বলে ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে।

“আমি আগে ১৫ লাখ টাকার একটা ঋণ নিয়েছিলাম। পরিশোধের পর ৮ লাখ টাকা বকেয়া ছিল। সেই টাকার জন্য আমার বাবা অসুস্থ থাকা অবস্থায় ম্যানেজার ও জুলফিকার আমার বাসায় গিয়ে যাচ্ছেতাই আচরণ করে। এখন দেখানো হচ্ছে আমার নামে ৫৮ লাখ টাকার ঋণ, যার কিছুই আমি জানি না।”

১৫ অক্টোবর ব্যাংকে অডিটের সময় তিনি নিজেও উপস্থিত ছিলেন জানিয়ে পল্টু বলেন, “অডিটের অফিসাররা কাগজপত্র যাচাই করে বলেছে, আমার জাল সই করে ওই টাকা তোলা হয়েছে। ওই সময় আমি ম্যানেজারকে গালিও দিয়েছি, আমার বাবা অসুস্থ থাকাকালে ঋণের ৮ লাখ টাকার জন্য আমার সাথে কী করেছে। আর এখন এত বড় ঋণ আসল কী করে?

“ভাই আমার মাথা ঠিক নেই। এখন কী করব বুঝতেছি না।”    

নাসির উদ্দীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা কয়েকজন অডিট কমিটি এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে বিষয়টি মৌখিকভাবে জানিয়েছি। দেখি এখন তারা কী করেন।”

শাখা ব্যবস্থাপক শাহরিয়ার কবির জানান, মামলার আসামিদের মধ্যে জুলফিকারই পলাতক আছেন। আগের শাখা ব্যবস্থাপক ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ফেরদৌস আলমসহ সাতজনকে প্রত্যাহার করে হেড অফিসে নেওয়া হয়েছে।

মামলার দুই আসামির মোবাইলে ফোন করে তাদের পাওয়া যায়নি।

রাকিব উদ্দিন নামে জুলফিকারের এক মামাত ভাই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারাও জুলাফিকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।

মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব গোয়েন্দা পুলিশের হাতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ অতিরিক্ত উপকমিশনার তৌহিদুল ইসলাম বলেছেন, “আমরা দুই-এক দিনের মধ্যে থানা থেকে মামলার নথি পেয়ে যাব।”