হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান কারাগারে কোয়ারেন্টিনে

নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে মারধরের পর র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা নিয়ে কারাগারে গেছেন সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Oct 2020, 03:40 AM
Updated : 27 Oct 2020, 03:40 AM

সোমবার রাতে গ্রেপ্তারের পর মঙ্গলবার প্রথম প্রহরে তাকে র‌্যাব হেফাজত থেকে কারাগারে পাঠানো হয়।

তার আগে মদ্যপান ও ওয়াকিটকি ব্যবহার করার অপরাধে তাকে সাজা দেয় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেনেন্ট কর্নেল রকিবুল হাসান মঙ্গলবার সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ইরফানকে রাত দেড়টার পরে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

ইরফানকে নেওয়া হয়েছে কেরানীগঞ্জের কারাগারে।

ঢাকার জেলার মাহবুবুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ইরফান কারাগারে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকবেন।  

করোনাভাইরাস মহামারীকালে কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী যে কোনো নতুন বন্দিকে একটি সেলে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়।

ইরফানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা করতে যাচ্ছে র‌্যাব।

মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যে তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো করা হবে বলে র‌্যাব কর্মকর্তা রকিবুল জানান।

পুরান ঢাকার তৃতীয়বারের এমপি হাজী সেলিমের দ্বিতীয় সন্তান ইরফান নিজেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর। আরেক সংসদ সদস্য নোয়াখালীর একরামুল করিম চৌধুরীর জামাতা তিনি।

বিদেশে লেখাপড়া করে আসা ইরফান বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মদিনা গ্রুপের পরিচালকদের একজন।

ইরফান ও তার সহযোগীদের হাতে নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা মারধরের শিকার হওয়ার জের ধরে সোমবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে সোয়ারিঘাটের দেবদাস লেনে হাজী সেলিমের বাড়ি ঘেরাও করে অভিযান শুরু করে র‌্যাব।

কিছুক্ষণের মধ্যে ভবনের চতুর্থ তলা থেকে ইরফান ও তার দেহরক্ষী মোহাম্মদ জাহিদকে আটক করে।

সাদা রঙের নয়তলা ওই ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় ইরফান সেলিম থাকেন জানিয়ে বিকালে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার বলেন, ওই দুই ফ্লোর থেকে দুটি অবৈধ বিদেশি পিস্তল, গুলি, একটি এয়ারগান, ৩৭টি ওয়াকিটকি, একটি হাতকড়া এবং বিদেশি মদ ও বিয়ার পাওয়া গেছে।

“আগ্নেয়াস্ত্রের কোনো লাইসেন্স নেই। আর ওয়াকিটকিগুলোও অবৈধ, কালো রঙের এসব ওয়াকিটকি শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করতে পারেন।”

পরে মদ্যপান ও ওয়াকিটকি ব্যবহার করার অপরাধে ইরফান এবং তার দেহরক্ষী জাহিদকে ছয় মাস করে এক বছরের কারাদণ্ড দেয় সারওয়ার আলম নেতৃত্বাধীন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

পরে রাত সোয়া ৮টার দিকে ইরফান ও তার দেহরক্ষীকে ওই ভবন থেকে বের করে টিকাটুলীতে র‌্যাব-৩ এর কার্যালয়ে নেওয়া হয়।

হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের ঘর থেকে উদ্ধার করা হাতকড়া ও ওয়াকিটকি।

চকবাজারে ‘নির্যাতন কেন্দ্র’

দেবীদাস লেনের ভবনে অভিযানের মধ্যেই চকবাজারের আশিক টাওয়ারে অভিযান চালিয়ে ইরফানের ‘নির্যাতন কেন্দ্রের’ সন্ধান পাওয়ার কথা জানায় র‌্যাব।

ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, ইরফানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৬তলা ওই ভবনের ছাদের একটি কক্ষে অভিযান চালানো হয়। সেখানে হকিস্টিক, হাতকড়া, ছোরা, মোটা রশি, গামছা, ইলেকট্রিক শক দেওয়ার তারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম এবং ইয়াবা সেবনের সরঞ্জাম পাওয়া যায়।

“এখানে বিভিন্নজনকে এনে নির্যাতন করতেন ইরফান।”

পরে ওই ভবনে গিয়ে দেখা যায়, ১৬তলায় মদিনা ডেভেলপার কোম্পানির অফিস রয়েছে। তার উপরে ছাদে একপাশের বড় একটি কক্ষে থেকে ‘নির্যাতনের’ বিভিন্ন অস্ত্র-সরঞ্জাম জব্দ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করছিলেন র‌্যাব সদস্যরা।

কম্পিউটার মনিটর-সোফা দিয়ে সাজানো এই কক্ষের পূর্ব পাশে রয়েছে ব্যাডমিন্টন খেলার ব্যবস্থা।

ঘটনার সূত্রপাত যেখানে

রোববার রাতে ধানমণ্ডি এলাকায় সংসদ সদস্যের স্টিকারযুক্ত হাজী সেলিমের একটি গাড়ি থেকে নেমে নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট মো. ওয়াসিফ আহমেদ খানকে মারধর করা হয়।

এ ঘটনায় সোমবার ধানমণ্ডি থানায় দায়ের করা মামলায় ইরফান সেলিম ছাড়াও হাজী সেলিমের প্রোটোকল অফিসার এবি সিদ্দিক দিপু, ইরফানের দেহরক্ষী মোহাম্মদ জাহিদ এবং গাড়িচালক মিজানুর রহমানের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আরও তিনজনকে আসামি করা হয়।

তাদের বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে পথরোধ করে সরকারি কর্মকর্তাকে মারধর, জখম ও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ আনেন মামলার বাদী ওয়াসিফ আহমেদ খান।

মামলার এজাহারে বলা হয়, লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ রোববার রাত পৌনে ৮টার দিকে স্ত্রীকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে কলাবাগানের দিকে যাচ্ছিলেন। ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো একটি কালো রঙের ল্যান্ড রোভার গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-৫৭৩৬) পেছন থেকে তার মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়।

ওয়াসিফ ও তার স্ত্রী ধাক্কা সামলে মোটরসাইকেল থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে ওই গাড়ি থেকে জাহিদ, দিপু এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও দুই-তিনজন ‘অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ’ করতে করতে নেমে আসেন এবং ‘মারধর’ শুরু করেন।

তারা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ ও তার স্ত্রীকে ‘উঠিয়ে নেওয়ার এবং হত্যার’ হুমকি দেন বলেও মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।

ওই ঘটনার পরে একজন প্রত্যক্ষদর্শী মোবাইল ফোনে লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফের বক্তব্য ধারণ করেন, যা ইতোমধ্যে ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে নৌবাহিনীর এই কর্মকর্তাকে রক্তাক্ত মুখে বলতে শোনা যায়, তিনি পরিচয় দেওয়ার পরও তাকে মারধর করা হয়েছে, তার স্ত্রীর গায়েও ‘হাত দিয়েছে’।

মামলা হওয়ার পরপরই গাড়ির চালক মিজানুরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সোয়ারিঘাটে হাজী সেলিমের ওই বাড়ি ঘিরে অভিযান শুরু করে র‌্যাব।