পুরান ঢাকার তৃতীয়বারের এমপি হাজী সেলিমের দ্বিতীয় সন্তান ইরফান আরেক সংসদ সদস্য নোয়াখালীর একরামুল করিম চৌধুরীর জামাতা। বিদেশে লেখাপড়া করে আসা ইরফান বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মদিনা গ্রুপের পরিচালকদের একজন।
ইরফান নিজেও একজন জনপ্রতিনিধি; পুরান ঢাকার সোয়ারি ঘাট, মিটফোর্ড রোড ও আশপাশের এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তিনি।
নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় মামলা হওয়ার পর সোমবার দুপুরে সোয়ারি ঘাট এলাকায় সাংসদ হাজী সেলিমের বাড়ি ঘেরাও করে অভিযান চালায় র্যাব। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
“আগ্নেয়াস্ত্রের কোনো লাইসেন্স নেই। আর ওয়াকিটকিগুলোও অবৈধ, কালো রঙের এসব ওয়াকিটকি শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করতে পারেন।”
সন্ধ্যায় র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আশিক বিল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের এই দণ্ডের পাশাপাশি দুজনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা দায়ের করা হবে।
র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেনেন্ট কর্নেল রকিবুল হাসান মঙ্গলবার সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ইরফানকে রাত দেড়টার পরে কারাগারে পঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে মামলা করা হয়নি। মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
চকবাজারে ‘নির্যাতন কেন্দ্র’
দেবীদাস লেনের ভবনে অভিযানের মধ্যেই চকবাজারের আশিক টাওয়ারে অভিযান চালিয়ে ইরফানের ‘নির্যাতন কেন্দ্রের’ সন্ধান পাওয়ার কথা জানায় র্যাব।
ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, ইরফানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৬তলা ওই ভবনের ছাদের একটি কক্ষে অভিযান চালানো হয়। সেখানে হকিস্টিক, হাতকড়া, ছোরা, মোটা রশি, গামছা, ইলেকট্রিক শক দেওয়ার তারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম এবং ইয়াবা সেবনের সরঞ্জাম পাওয়া যায়।
“এখানে বিভিন্নজনকে এনে নির্যাতন করতেন ইরফান।”
কম্পিউটার মনিটর-সোফা দিয়ে সাজানো এই কক্ষের পূর্ব পাশে রয়েছে ব্যাডমিন্টন খেলার ব্যবস্থা।
ঘটনার সূত্রপাত যেখানে
রোববার রাতে ধানমণ্ডি এলাকায় সংসদ সদস্যের স্টিকারযুক্ত হাজী সেলিমের একটি গাড়ি থেকে নেমে নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট মো. ওয়াসিফ আহমেদ খানকে মারধর করা হয়।
ভিডিও থেকে নেওয়া ছবি
তাদের বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে পথরোধ করে সরকারি কর্মকর্তাকে মারধর, জখম ও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ আনেন মামলার বাদী ওয়াসিফ আহমেদ খান।
মামলার এজাহারে বলা হয়, লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ রোববার রাত পৌনে ৮টার দিকে স্ত্রীকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে কলাবাগানের দিকে যাচ্ছিলেন। ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো একটি কালো রঙের ল্যান্ড রোভার গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-৫৭৩৬) পেছন থেকে তার মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়।
ওয়াসিফ ও তার স্ত্রী ধাক্কা সামলে মোটরসাইকেল থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে ওই গাড়ি থেকে জাহিদ, দিপু এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও দুই-তিনজন ‘অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ’ করতে করতে নেমে আসেন এবং ‘মারধর’ শুরু করেন।
তারা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ ও তার স্ত্রীকে ‘উঠিয়ে নেওয়ার এবং হত্যার’ হুমকি দেন বলেও মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।
ভিডিও থেকে নেওয়া ছবি
মামলা হওয়ার পরপরই গাড়ির চালক মিজানুরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সোয়ারিঘাটে হাজী সেলিমের ওই বাড়ি ঘিরে অভিযান শুরু করে র্যাব।
দেখা মেলেনি হাজী সেলিম ও তার স্ত্রীর
অভিযানের মধ্যে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ ভবন থেকে ইরফান ও তার দেহরক্ষীকে আটক এবং আগ্নেয়াস্ত্র, মদ, ওয়াকিটকি, হাতকড়া উদ্ধারের কথা জানান।
সাংসদ হাজী সেলিম কোথায় জানতে চাইলে আশিক বিল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাজী সেলিম বাড়িতে নেই। অভিযানের আগেই তিনি তার স্ত্রীসহ ডাক্তারখানায় গেছেন বলে জানা গেছে।”
তবে কোন চিকিৎসকের কাছে গেছেন, তা জানাতে পারেননি র্যাব এই কর্মকর্তা।
২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচারে হাজী সেলিম।
আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক হাজী সেলিম এবার তৃতীয় মেয়াদে ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য।
পুরান ঢাকার আলোচিত-সমালোচিত হাজী সেলিম বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েই ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এই এলাকা থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সে সময় সাবেক ঢাকা-৮ আসনের বিএনপি প্রার্থী আবুল হাসনাতকে হারালেও ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি হেরে যান বিএনপি প্রার্থী নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টুর কাছে।
এরপর সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনর্বিন্যাসের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে ওই আসনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বিএনপির নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টুকে হারিয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন।
২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে হারিয়ে চমক দেখান হাজী সেলিম।
এরপর ২০১৮ সালে আবার নৌকা প্রতীক ফিরে পেয়ে ঢাকা-৭ আসনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা হাজী সেলিমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মদিনা গ্রুপের আবাসন, সিমেন্ট, পানির ট্যাংক, পাম্প, শিপিংসহ আরও নানা খাতে ব্যবসা রয়েছে।
এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন হাজী সেলিম, চেয়ারম্যান তার স্ত্রী বেগম গুলশান আর সেলিম, বড় ছেলে মোহাম্মদ সোলাইমান সেলিম উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অন্য দুই ছেলে ইরফান সেলিম, মোহাম্মদ সালমান সেলিম এবং এক মেয়ে জারিন চৌধুরী সেলিম কোম্পানির পরিচালক পদে আছেন।
বিদেশে লেখাপড়া করে আসা ইরফান সেলিম বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মদিনা গ্রুপের পরিচালকদের একজন। মদিনা গ্রুপের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া ছবি।
বিদেশ থেকে লেখাপড়া করে এসে বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন ইরফান সেলিম।
এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হন।
নির্বাচনী হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে ব্যবসায় প্রশাসনে ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেওয়ার কথা লিখেছিলেন তিনি।
২৯ বছর বয়সী ইরফান সেলিম হলফনামায় সম্পদের বিবরণে তার কাছে নগদ ৩০ লাখ টাকা এবং শেয়ার ও বন্ডে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা লিখেছিলেন।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন লিটন হায়দার, মঈনুল হক চৌধুরী ও কাজী মোবারক হোসেন]