তিতুমীরে অবস্থানরত স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে কর্মচারীদের সংঘর্ষ

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ঢাকার তিতুমীর কলেজে নমুনা সংগ্রহের কাজে থাকা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে কলেজ কর্মচারীদের সংঘর্ষের পর ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 June 2020, 11:47 AM
Updated : 23 June 2020, 04:21 PM

মঙ্গলবার রাতে ওই সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ১৬ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১০ জন জেকেজি হেলথকেয়ার নামের ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী।

দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মত তিতুমীর সরকারি কলেজও এখন বন্ধ। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে বুথ বসিয়ে নমুনা সংগ্রহের কাজে থাকা জেকেজি হেলথকেয়ারের প্রায় দুইশ কর্মীর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে এই কলেজের কয়েকটি ভবনে।

কলেজ কর্মচারীদের ভাষ্য, সোমবার রাতে জেকেজির এক নারী কর্মী রাতে এক ভবন থেকে আরেক ভবনে এক পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তারা বাধা দেন। এর জের ধরে মঙ্গলবার রাতে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।

সংঘর্ষের জন্য জেকেজির কর্মীদের দায়ী করে কলেজ অধ্যক্ষ আশরাফ হোসেন বলেন, “তারা বাইরে থেকে সন্ত্রাসী এনে আমাদের স্বল্পসংখ্যক কর্মচারীর উপর হামলা চালিয়েছে। কর্মচারীদের বাড়িঘর তছনছ করেছে। কলেজের গাড়ি চালক সাহাবুদ্দিনের হাতে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করেছে “

অন্যদিকে জেকেজি হেলথ কেয়ারের আহ্বায়ক ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী পাল্টা অভিযোগ এনে বলেছেন, কলেজ কর্মচারীরা তাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের কলেজ ক্যাম্পাস থেকে ‘বের করে দিতে চায়’। সেজন্য তারা নানা ‘ছুতো খোঁজে’।

“কলেজের কর্মচারীরা রাতে আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। হুমায়ুন নামে একজনকে তারা গুরুতর জখম করে। এসব কর্মচারী এবং তাদের বাহিনীর হামলায় আমাদের ১০ জন এখন হাসপাতালে ভর্তি। যারা আছেন তারা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।”

বিভিন্ন বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে যে আগে থেকেই জটিলতা তৈরি হচ্ছিল, বনানী থানার ওসি মো. নূরে আযম মিয়াও সে কথা বলছেন। তার ধারণা, সেসব কিছু মিলিয়েই মঙ্গলবার রাতে দুইপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে কলেজ অধ্যক্ষ জানান, মহামারীর এই সঙ্কটের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিঠি পেয়ে তারা কলেজের নির্মাণাধীন নতুন ভবন ছাড়াও অডিটোরিয়াম এবং আরেকটি ভবন জে কে জি হেলথকেয়ারের কর্মীদের ছেড়ে দিয়েছেন।

কলেজ এবং হোস্টেল বন্ধ থাকায় সেখানে ছাত্র-শিক্ষক কেউ না থাকলেও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির ২০-২২ জন কর্মচারী আছেন। তাদের কারো কারো সঙ্গে পরিবারও থাকে।

কলেজের কয়েকজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করা শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জেকেজির কর্মীদের ‘আচার-আচরণ, পোশাক এবং চলাফেরা’ নিয়ে কর্মচারীরা ‘বিরক্ত’ ছিলেন। রোজার সময় জেকেজির কর্মীদের ‘গানবাজনা’ নিয়েও তাদের আপত্তি ছিল।

অন্যদিকে জেকেজির একজন স্বাস্থ্যকর্মী বলেছেন, “আমরা দিনভর করোনাভাইরাস রোগীদের নিয়ে নাড়াচাড়া করি। বাসাবাড়ি ছেড়ে এসে এখানে থাকছি অনেক কষ্ট করে। নিজেদের স্বাভাবিক রাখতে কাজ শেষে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সহকর্মীদের মধ্যে গল্পগুজব করি, এটা তাদের (কলেজ কর্মচারী) পছন্দ না।”

ডা. সাবরিনা আরিফ অভিযোগ করেন, তার কর্মীদের সরানোর জন্য কলেজ কর্মচারীরা বিভিন্ন সময়ে পানি বা বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে দিয়েছে। নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের ‘উত্ত্যক্তও করা হয়েছে’ বিভিন্ন সময়ে। গত দুই মাসে তাদের ১০টি মোবাইল ফোন চুরি গেছে।

“তারা নানাভাবে হয়রানি করছে যেন আমরা এখান থেকে চলে যাই। তারপরও আমরা স্বাস্থ্যকর্মীদের ধৈর্য্য ধরে থাকতে সবসময় বলা হয়ে থাকে।“

পাল্টা অভিযোগ করে কলেজ অধ্যক্ষ বলেন, “এই ক্রান্তিকালে তাদের পাশে থাকার উদ্দেশ্যে প্রথমে একটি ভবন, পরে অডিটোরিয়াম আর মানবিক ভবনেও তাদের থাকার ব্যবস্থা করলাম। অথচ তারা কলেজ ক্যাম্পাসকে নিজেদের মত ব্যবহার করছে। কর্মচারীদের নানাভাবে হুমমি-ধামকি দিয়ে আসছে।”

অধ্যক্ষের ভাষ্য, তার এক কর্মচারী সোমবার মধ্যরাতে তাকে ফোন করে বলেন, এক নারী স্বাস্থ্যকর্মী কলেজের অন্য এক ভবনে তার এক পুরুষ সহকর্মীর কাছে যাওয়ায় সময় কর্মচারীরা বাধা দেয়। কিন্তু সেই নারী স্বাস্থ্যকর্মী বাধা না মেনে সেই পুরুষ সুপারভাইজারের কাছে যায়।

কলেজের নৈশপ্রহরী তখন ওই ভবনের কলাপপসিবল গেইটে তালা লাগিয়ে দেয়। বিষয়টি পুলিশকে জানানোর পর পুলিশ এসে তালা খুলে দেয়।

তবে ওসি নূরে আযম মিয়া বলেছেন, “বিষয়টি যেভাবে বলা হচ্ছে ঠিক তা নয়। নিরাপত্তার কারণে তালা এমনেই লাগানো থাকে। তাছাড়া ওই নারী স্বাস্থ্যকর্মী প্রয়োজনীয় কথা বলতেই সুপারভাইজারের কাছে গিয়েছিলেন।”

এ নিয়ে উত্তেজনার মধ্যেই মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার পর কলেজ ক্যাম্পাসে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

সংঘর্ষে কলেজের ছয়জন আহত হয়েছেন জানিয়ে অধ্যক্ষ বলেন, আহতদের হোস্টেলের মসজিদে রাখা হয়েছে।

এদিকে সংঘর্ষের পর স্বাস্থ্যকর্মীরা মঙ্গলবার গভীর রাত পর্যন্ত কলেজের সামনের সড়ক অবরোধ করে রাখে।

অনেকে আহত হওয়ায় এবং কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক থাকায় জে কে জি হেলথকেয়ারের স্যাম্পল কলেকশন বুথগুলো বুধবার বন্ধ রাখতে হয়েছে বলে জানান ডা. সাবরিনা।

তিনি অভিযোগ করেন, রাতে সংঘর্ষের পর কলেজ অধ্যক্ষকে ক্যাম্পাসে আসতে বলা হলেও তিনি আসেননি।

অন্যদিকে অধ্যক্ষ বলছেন, নিরাপত্তার কারণে তিনি নিজে না গেলেও একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু তাকে কলেজে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

বনানী থানার ওসি মো. নূরে আযম মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা দুইপক্ষকে নিয়ে বসছি, আলোচনা করছি। পরিস্থিতি যাতে স্বাভাবিক হয়, সেই চেষ্টা হচ্ছে।”