করোনাভাইরাস: গণরুম-সমাবেশে শঙ্কা ঢাবিতে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ও গণরুমের ‘গাদাগাদি’ পরিবেশ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মসূচিতে জমায়েত শিক্ষার্থীদের সহজেই নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করছে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2020, 06:39 PM
Updated : 13 March 2020, 06:44 PM

এই পরিস্থিতিতে তারা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার দাবি জানালেও তাতে সায় দিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলছেন, করোনাভাইরাস আতঙ্কে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ সমাধান নয়, হতে হবে সতর্ক।

এদিকে নভেল করোনাভাইরাস আতঙ্কের এই সময়ে জ্বর-কাশি নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা ও চিকিৎসা সেবা না পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে।

চার দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের গণরুমের শিক্ষার্থী মো. হুজায়ফা। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ভীষণ জ্বর, মাথাব্যাথা ও বমি বমি ভাব নিয়ে তিনি চিকিৎসা নিতে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

ওই সময় কর্তব্যরত চিকিৎসক অবস্থা খারাপ দেখে তাকে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করাতে রাজধানীর কুর্মিটোলা হাসপাতালে যেতে বলেন।

চিকিৎসকের কথা মতো সেখানে গেলেও করোনাভাইরাস পরীক্ষা করাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অসম্মতি এবং আইইডিসিআরে যোগাযোগ করতে না পেরে নিরুপায় হয়ে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে ফিরে আসেন হুজায়ফা।

করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষায় এখন মাস্ক পরে চলাচল করছেন অনেকেই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থী থাকেন গণরুমে। হুজায়ফার মতো প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের অনেক শিক্ষার্থীকে হলগুলোর গণরুমে থাকতে হয়, যেখানে কোনো কোনো হলের চার বেডের এক কক্ষে ২০-৩০ জন, আবার কোথাও ৫০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে একটি বড় রুমে থাকেন।

এদের কারও নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঘটলে দ্রুত তা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে শঙ্কায় অনেক শিক্ষার্থীই মনে করছেন, এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা ‘জরুরি’।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিয়ান তারান্নুম বলেন, “ক্লাস বন্ধ না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে জনসমাগম বা মানুষের সংস্পর্শ কমবে না। ক্যাম্পাসে ধুলাবালি, ময়লা, খোলা জায়গায় কফ-থুতু ইত্যাদির মধ্যে সচেতন থাকা সম্ভব নয়।

“বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলে সেশন জটের ঝুঁকি থাকলেও তা জীবনের চেয়ে বেশি না।”

নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জিয়াউর রহমান জয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ক্যাম্পাসে আসলে অনেকের সাথে হ্যান্ডশেক, মেলামেশা ও ঘোরাফেরা করতে হয়। এক সাথে চা-সিগারেট খাওয়া, যত্রতত্র থুথু-কফ ফেলা ইত্যাদি চলে। এ অবস্থায় কীভাবে সতর্ক থাকা যায়?”

হলে থাকাকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে দেখছেন বিজয় একাত্তর হলের গণরুমের এক শিক্ষার্থী।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপানারা জানেন বিজয় একাত্তর হলে বিশাল বিশাল গণরুম রয়েছে। যেখানে দুটি রুমে দুইশরও বেশি শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে থাকে। এই মুহূর্তে এই কক্ষগুলো খুবই বিপজ্জনক।”

স্যার এ এফ রহমান হলের শিক্ষার্থী হুজায়ফার সর্বশেষ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি আছেন।

হুজায়ফার শারীরিক অবস্থা এখন ‘স্থিতিশীল’ বলে জানালেন সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. মো. জামিল আহমেদ শাহেদী।

তিনি শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতকাল রাতে ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছিল, সেখান থেকে কুর্মিটোলায় গিয়েছিল। আসলে শুধু ঠাণ্ডা-কাশি বা জ্বরের জন্য তো টেস্ট দেওয়া যায় না।

“যদি শ্বাসকষ্ট থাকে সেক্ষেত্রে আমরা তাকে কুর্মিটোলায় পাঠাব। এখন তাকে ওষুধ-পত্র দেওয়া হয়েছে, সে পর্যবেক্ষণে আছে।”

সেখানকার অফিস সহায়ক সিরাজুল ইসলাম বলেন, “শুধু শুধু আতঙ্কিত হয়ে গতকাল কুর্মিটোলায় গিয়েছিল। সেখানেও তাকে ছুঁয়েও দেখেনি, ঢাকা মেডিকেলেও তাকে ধরেও দেখেনি। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নাই। তার অবস্থা ভালো, কিছুটা জ্বর আছে।”

হুজায়ফা সম্পর্কে স্যার এফ রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত চার দিন ধরে তার (হুজায়ফা) জ্বর ছিল। গতকাল রাতে কুর্মিটোলায় যেই সময়ে গিয়েছিল, আসলে ওই সময়ে তো আর পরীক্ষা করা হবে না। এখন সে আমাদের মেডিকেল সেন্টারে আছে।

“ডাক্তারা তাকে দেখেছে, চিকিৎসা দিয়েছে। তার অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। এটা করোনাভাইরাস নয়, আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। করোনা ভাইরাসের রোগী তো আর বমি করে না, মাথাব্যাথাও করে না, এটা তার স্বাভাবিক জ্বর। এখন ঋতু পরিবর্তন হচ্ছে, জ্বর হওয়া স্বাভাবিক। আমরা শিক্ষিত মানুষ ভয় পেলে তো হবে না।”

গণরুম নিয়ে শিক্ষার্থীদের আতঙ্কের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “গতকাল আমাদের প্রভোস্ট মিটিং ছিল। সেখানে প্রতিটি আবাসিক হলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, সাবান, স্যানিটাইজার, পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি সরবরাহ এবং হলগুলোতে নিয়মিত হাউজ টিউটরদের শিক্ষার্থীদের খোঁজ-খবর নিতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি। সব হলেই শিক্ষার্থীদের এ রকম পরিবেশে থাকতে হয়। এজন্য হল তো বন্ধ রাখা যাবে না।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের ক্রীড়াকক্ষ এখন ব্যবহার হচ্ছে ‘গণরুম’ হিসেবে। এই কক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে ‘বঙ্গভবন’ নামে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

বিজয় একাত্তর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুল বাছির বলেন, “সব হলেই তো (গণরুমে) এ রকম পরিবেশে শিক্ষার্থীরা থাকে। আমরা তো আর ছাত্রদের বলতে পারি না তোমরা বাড়ি চলে যাও। বিশ্ববিদ্যালয় কোনো নির্দেশনা না দিলে আমরা হল কর্তৃপক্ষ তো কিছু বলতে পারি না।”

নভেল করোনাভাইরাস আতঙ্কের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখাকে সমাধান হিসেবে দেখছেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান।

এ বিষয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাভাইরাসে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক ও সচেতন থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। গতকাল প্রভোস্ট কমিটির মিটিংয়ে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। হলগুলোতে আমাদের শিক্ষকরা খোঁজ-খবর নেবেন। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা সমাধান নয়।”

প্রভোস্ট কমিটির মিটিং শেষে বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, “বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীর বা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কোনো সদস্যের সর্দি-কাশি, জ্বর, গলাব্যথাসহ কোনো উপসর্গ দেখা দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রের পরামর্শ ও চিকিৎসা সেবা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান মেডিকেল অফিসার কর্তৃক প্রচারিত লিফলেটের পরামর্শ অনুসরণ করতে হবে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান মেডিকেল অফিসার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভাইরাস মোকাবিলায় সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। জনসমাগমস্থল এড়িয়ে চলা, করমর্দন ও কোলাকুলি থেকে বিরত থাকতেও বলা হয়েছে।