সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলেই চারদিকে নভেল করোনাভাইরাসের খবর। ফেইসবুকেও একই কথা। তবে কি ওই রোগই হল?
আপনি গেলেন হাসপাতালে। নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখে ডাক্তারও একই সন্দেহ প্রকাশ করলেন। কিন্তু কীভাবে বোঝা যাবে সত্যিই আপনার মধ্যে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে কি না?
সাধারণ বিবেচনা বলে, নিশ্চিত হতে গেলে পরীক্ষা করাতে হবে। কী সেই পরীক্ষা? কীভাবে তা হয়?
লাগবে লালা বা কফ
নতুন করোনাভাইরাস বংশবৃদ্ধি করে মানুষের শ্বাসতন্ত্রে। আর সে কারণেই শ্বাসতন্ত্রের রোগের উপসর্গ দেখা দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) নিয়ম হল, এ পরীক্ষার জন্য রোগীর লালা, শ্লেষ্মা বা কফ সংগ্রহ করতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের বিশেষজ্ঞরাও একই নিয়ম অনুসরণ করছেন।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অন্য অনেক রোগের পরীক্ষায় যেমন রক্ত, মল বা মূত্রের নমুনা প্রয়োজন হয়, করোনাভাইরাসের পরীক্ষা সেসব দরকার নেই।
“আমরা সম্ভাব্য রোগীর মুখের লালা বা নাকের শ্লেষ্মা সংগ্রহ করি। সেটা পরীক্ষা করলেই বোঝা যায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আছে কি না?”
হটলাইন করোনাভাইরাসের কোনো উপসর্গ দেখা দিলে বা সন্দেহ হলে যোগাযোগের জন্য হটলাইন চালু করেছে আইইডিসিআর। তাতে ফোন করলে বাড়িতে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করবেন আইইডিসিআরের কর্মীরা। নম্বরগুলো হলো: ০১৯২৭৭১১৭৮৪, ০১৯২৭৭১১৭৮৫, ০১৯৩৭০০০০১১, ০১৯৩৭১১০০১১। |
নমুনা যাবে ল্যাবে
সিএনএন এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালে নমুনা সংগ্রহ করার পর তা সংরক্ষণ করা হবে স্টেরাইল টিউব বা ভায়ালে। এর মানে হল, ওই টিউব বা ভায়াল আগে থেকেই জীবাণুমুক্ত করা। সব পরীক্ষার ক্ষেত্রেই এ সাধারণ নিয়ম মানা হয়।
এরপর সেই টিউব অতিমাত্রায় শীতল করে বরফের বাক্সে ভরে পাঠানো হয় ল্যাবরেটরিতে, যাতে নমুনা নষ্ট না হয়। নমুনা এমন ল্যাবে পাঠাতে হবে, যেখানে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে, সেই সঙ্গে আছে টেস্ট কিট। বাংলাদেশে কেবল আইইডিসিআরেই এ পরীক্ষা করা সম্ভব।
আলমগীর বলেন, করোনাভাইরাস, নিপা বা ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাস যে ল্যাবে পরীক্ষা করা হবে, তার জৈব নিরাপত্তা বা বিএসএল মান থাকতে হয় কমপক্ষে দুই। আইইডিসিআরে বিএসএল-২ এবং বিএসএল-৩ দুই মানের ল্যাবই আছে।
“বাংলাদেশে আরও দুয়েকটি মেডিকেল কলেজে এ ধরনের ল্যাব আছে। তবে সেখানে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। কারণ ল্যাব থাকলেও হয়ত রোগতত্ত্ববিদ নেই, র্যাপিড রেসপন্স টিম নেই।”
ল্যাবে নমুনা পৌঁছানোর পর হবে পরীক্ষার ব্যবস্থা। এ পরীক্ষার নাম আরটি-পিসিআর বা রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ পলিমেরেজ চেইন রিঅ্যাকশন। আর নমুনায় করোনাভাইরাস আছে কি না তা বুঝতে ব্যবহার করতে হবে বিশেষ রি-এজেন্ট।
সিএনএন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি নভেল করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য বিশেষ ধরনের একটি কিট তৈরি করেছে। সেই কিট ব্যবহার করে রিয়েল টাইম আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করা হয়।
আলমগীর জানান, আইইডিসিআর এ পরীক্ষায় ব্যবহার করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া একটি কিট, যাকে তারা বলেন পিসিআর প্রাইমারি প্রোব রি-এজেন্ট।
প্রতিটি প্রাণীর ডিএনএ বৈশিষ্ট্য যেমন আলাদা, তেমনি প্রতিটি ভাইরাসের জিন বিন্যাসও হয় আলাদা ধরনের। একে বলে ভাইরাল জিনোম। রোগীর নমুনায় করোনাভাইরাসের জিনোম বৈশিষ্ট্যের কোনো জেনেটিক বিন্যাস পাওয়া যায় কি না- সেটাই আরটি-পিসিআর পরীক্ষার লক্ষ্য।
নভেল করোনাভাইরাস যেহেতু আরএনএ ভাইরাস, সেহেতু পরীক্ষার জন্য প্রথমে রোগীর নমুনা থেকে সব ধরনের আরএনএ আলাদা করে ফেলা হয়। এরপর তার সঙ্গে মেশানো হয়রি-এজেন্ট এবং সত্যিকারের করোনাভাইরাস থেকে পাওয়া জিনের উপাদান। পরে সেই মিশ্রণ পরীক্ষা করা হয় নির্দিষ্ট যন্ত্রে।
রোগীর নমুনায় যদি করোনাভাইরাস থেকে থাকে, তাহলে এ পরীক্ষায় তার সংখ্যা বাড়বে। ফলাফল আসবে ‘পজেটিভ’। আইইডিসিআর তখন সেই নমুনা পাঠাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় ফের পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলছেন, তারা যেভাবে এ পরীক্ষা করেন, তাতে ফলাফল পেতে ঘণ্টা তিনেক সময় লাগে।
“নমুনা আনার পর অনেকগুলো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এটা যায়। আরএন এক্সট্রাকশন করতে হয়। সেখান থেকে পিসিআর মেশিনে দিয়ে সেটা রান করাতে হয়। আরও কিছু প্রক্রিয়া শেষে পরীক্ষাটি শেষ করতে আমাদের তিন ঘণ্টা সময় লাগে।”
তবে পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে নমুনা হাতে পাওয়ার ওপর। আরটি-পিসিআরের প্রতিটি পরীক্ষায় খরচ হচ্ছে পাঁচ হাজার টাকার বেশি। আপাতত এ ব্যয় সরকারই বহন করছে।
যথেষ্ট কিট আছে তো?
আলমগীর জানান, বর্তমানে আইইডিসিআরে প্রায় দেড় হাজার কিট মজুদ আছে। আরও কিছু কিট সংগ্রহ করা হচ্ছে, সেগুলো আসার পথে রয়েছে।
রোগটি বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়লে এই কিট দিয়ে সবার পরীক্ষা করা সম্ভব কি না জানতে চাইলে আলমগীর বলেন, রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেলে সবার ক্ষেত্রে পরীক্ষা করার প্রয়োজন হবে না।
“সারাদেশে আমাদের সার্ভেইলেন্স আছে। এখানে করোনাভাইরাস পজেটিভ কোনো পেশেন্ট পেলে আমরা সারা দেশে সব হাসপাতালে বলব সর্দি বা শ্বাসতন্ত্রের অসুস্থতা নিয়ে আসা রোগীর নমুনা পাঠাতে।
“নমুনা পাঠানোর পর সেগুলো পরীক্ষা করে যদি করোনাভাইরাস পজেটিভ পাওয়া যায়, তাহলে বোঝা যাবে এ রোগ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এটাকে বলে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন।
“তখন আর সবাইকে পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। হাসপাতালগুলোতে বলে দেওয়া হবে এ ধরনের লক্ষণ নিয়ে এলে তাকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ধরে নিয়ে সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে।”
এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারই অনুসৃত নীতি।
সর্দি-জ্বরের যেমন বিশেষ কোনো চিকিৎসা নেই, করোনাভাইরাসেরও তেমন বিশেষ কোনো চিকিৎসা নেই।
কোনো টিকা বা ভ্যাকসিন এখনো তৈরি না হওয়ায় আপাতত নিরাপদ থাকার একমাত্র উপায় হল, যারা আক্রান্ত হয়েছেন বা এ ভাইরাস বহন করছেন- তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।
বিবিসি লিখেছে, পরীক্ষায় কারও মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত হলে তার মধ্যে যে উপসর্গগুলো আছে, সেগুলো সারাতেই মূলত চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আর রোগীর স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই ভাইরাসকে প্রতিহত করতে চেষ্টা চালাতে থাকে।
কিন্তু কারও মধ্যে নিউমোনিয়ার মতো স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দিলে রোগীকে প্রয়োজনে অক্সিজেন দেওয়া যেতে পারে। জটিলতা বেড়ে গেলে ভেন্টিলেটশনে (কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসযন্ত্র) রাখা যেতে পারে। এরকম রোগীদের প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের অবস্থা এরকম সঙ্কটাপন্ন হতে পারে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হলে এ রোগ কিছুদিন পর এমনিতেই সেরে যেতে পারে। তবে ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্র বা ফুসফুসের পুরোনো রোগীদের ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। এটি মোড় নিতে পারে নিউমোনিয়া, রেসপাইরেটরি ফেইলিউর বা কিডনি অকার্যকারিতার দিকে। পরিণতিতে ঘটতে পারে মৃত্যু।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ৩ শতাংশের মতো।