শহীদ মিনারের পেছনে এখনও সেই ‘মাজার’

উচ্চ আদালতের আদেশে আট বছর আগে শহীদ মিনারের পেছনের কথিত মাজারের অবকাঠামো ভেঙে ফেলা হলেও এখনও সেখানে আসর জমানো হচ্ছে, ‘বাবার’ সেবা-যত্ন করছেন খাদেমরা।

রাসেল সরকারমো. , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Feb 2020, 10:22 AM
Updated : 20 Feb 2020, 10:23 AM

যে কবর ঘিরে ওই মাজার গড়ে উঠেছিল, সেই কবর এখনও লালসালুতে মোড়া। সেখানকার প্রবেশদ্বারের উপরে লেখা রয়েছে ‘হযরত তেল শাহ (রহ.) মাজার শরীফ’।

খাদেম পরিচয় দেওয়া কয়েকজন ব্যক্তি দিনের বেলা ধোয়া-মোছাসহ যত্ন-আত্তি করেন, সন্ধ্যার পর নিয়মিত বাতি জ্বালান তারা। প্রতি সপ্তাহে একবার মিলাদ এবং নিয়মিত গান বাজনাও হয়ে।

এর আড়ালে সেখানে মাদক সেবন, যৌনকর্মসহ ‘নানা অপকর্ম’ হয়ে থাকে বলে অভিযোগ করেন গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে শহীদ মিনারের দেখভালের দায়িত্বে থাকা রিয়াদ হাসান ও মো. ইকবাল হোসেন।

২০১২ সালে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের একটি রিট আবেদনে সাড়া দিয়ে কবরটি রেখে মাজারের সব অবকাঠামো ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। ওই আদেশ পাওয়ার পর সে বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে জেলা প্রশাসনের সার্ভে টিম অভিযান চালিয়ে নয়টি বড় স্থাপনাসহ মোট ২০টি স্থাপনা উচ্ছেদ করে।

তবে কবর ঘিরে দুই কক্ষের ভবনের ছাদ ভেঙে ফেলা হলেও ভবনটি ভাঙা হয়নি।পরে অবৈধ কর্মকাণ্ড ঠেকাতে ৯০ দিন ওই মাজারে পুলিশ পাহারা বসানোর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে এর দায়িত্বভার বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

একটি দৈনিক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ওই রিট আবেদন করা হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনে ঢাকা মেডিকেলের সাবেক ছাত্রদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল, “এখানে কখনো কোনো মাজার ছিল না। ছিল সাধারণ একটা কবর। তারা এ-ও জানান, কবরটি মেডিকেল কলেজের কোনো এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর। পরে সেই কবরটি নব্বইয়ের দশকে এবং ২০০০ সালের দিকে ধীরে ধীরে মাজার বানিয়ে নিয়েছে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী।”

আদালতের আদেশে অভিযানের পর মাজারের কার্যক্রম কিছু দিন বন্ধ থাকলেও পরে আবারও তা জমতে থাকে। এখন মাজার পরিচালনায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ একটি কমিটিও রয়েছে।

নিজেকে মাজারের খাদেম পরিচয় দেওয়া অমল কুমার দাস বলেন, “আমি জগন্নাথ হলের কর্মচারী ছিলাম। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর এখন আর হলে থাকতে পারি না। তাই হোসনি দালানে থাকি। ১৯৭৪ সাল থেকে আমি এখানে সময় দেই। ছোট থেকে বড় হয়েছি এখানে, এটাকে শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। তাই বাবার সেবা-যত্ন করতেছি।”

আর কারা মাজারের সেবা করছে জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে আমরা ৩০-৩৫ জন আছি। ইউনিভার্সিটির স্টাফসহ বাইরের লোকও আছে। টিচারদের কেউ এখানে আসে না। স্টাফদের মধ্যে রয়েছে মেডিকেল সেন্টারের স্টাফ মনির সাহেব, সায়েন্স-এনেক্সের হেড দারোয়ান রঞ্জিত চক্রবর্তী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের স্টাফ মাখন, কার্জন হলের মালি, শঙ্করসহ অনেকে আছে।”

‘মাজারের’ আয়-ব্যয় নিয়ে জানতে চাইলে অমল বলেন, “এখানে লুকোচুরির কিছু নেই। এখন দিনে দশ টাকাও পড়ে না। আগে যখন ঢাকা মেডিকেলের দেওয়ালটা ছিল না তখন অনেকে মান্নত, টাকা-পয়সা নিয়ে আসত। মেডিকেলের রোগীরা আসত, তখন অনেক ইনকাম ছিল। এখন আমরা নিজেরা ১০-২০ টাকা করে চান্দা উঠিয়ে প্রতি বৃহস্পতিবার মিলাদ পড়াই।”

নিজেকে আদালতের দলিল লেখক পরিচয় দিয়ে শাহ আলম স্বপন নামে এক ব্যক্তি বলেন, তিনি এই মাজার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক।

“আর ঢাকা ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের স্টাফ মনিরুল ইসলাম মনির এটার সভাপতি। আমরা নিজেদের উদ্যোগেই প্রতি সপ্তাহে এখানে মিলাদের আয়োজন করি। রজব মাসের ১৩ তারিখে আমাদের বাৎসরিক ওরস হয়ে থাকে।”

মনিরুল ইসলাম মনিরকে সরাসরি পাওয়া না গেলেও তিনি মোবাইলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা আগে ঢাকা মেডিকেলের স্টাফরা পরিচালনা করত। মুনতাসীর মামুন স্যার  রিট করার পর ঢাকা ভার্সিটির অধীনে নিয়ে গেছে। মাজারটা রেখে বাকি সব কিছু ভেঙে ফেলেছে। এখানে টয়লেট ছিল, খাদেমের ঘর, নামাজের কক্ষ ছিল। আমরা তো আর সেগুলো করছি না। একুশে ফেব্রুয়ারির সময় এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসে পুরো জায়গাটা চেক করে। চেক করতে গিয়ে তারা তালাটা ভেঙে ফেলে। এটা আর লাগানো হয় না। আমরা ভিসির অনুমতি নিয়ে মাঝে মাঝে মিলাদ, গান-বাজনা করি। আমরা যখন ওরস করেছি ভিসি আমাদের অনুমতি দিয়েছেন।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অনুমতির কথা পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ধরনের মাজার এর মধ্যে আছে বলে আমার জানা নেই। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেট ম্যানেজারকে বলব প্রকৃত বিষয়টি আমাকে জানানোর জন্য। আমি সঠিকভাবে জানি না যে, এ সম্পত্তিটা কাদের। এটা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের হয় তাহলে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেট ম্যানেজারের সাথে কথা বলব। যদি গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বা সিটি করপোরেশনের অধীনে হয়, তারা বিষয়টি দেখবে। আর শহীদ মিনারের স্থাপনা গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তারা এটা রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ করবে।”।’’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, “এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেট অফিসের তত্ত্বাবধানে। মাজারটা ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। ওখানে কেউ কিছু করলে পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল বডিকে দায়িত্ব দেওয়া হবে, স্টেটকে বলা হবে এটা তদারকি করতে। আর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অনুমতি নিয়ে প্রোগ্রাম করে কি না, সেটা একটু খতিয়ে দেখতে হবে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত স্টেট ম্যানেজার সুপ্রিয়া সাহা বলেন, “শহীদ মিনারটা গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের স্থাপনা। এটা আমাদের দেখভালের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে মাজারের জায়গাটাসহ আশ-পাশের জায়গা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি।

তিনি বলেন, “মাজারটি হাই কোর্টের নির্দেশে অবৈধ ঘোষণার পর সেখানকার সবকিছু ভেঙে ফেলা হয়েছিল। কবর ও মসজিদ কক্ষের ঘরটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তবে আমরা শুনেছি, ওই ভাঙা ঘরটির কারণে এখানে অনেক অপকর্ম হচ্ছে। বাকি অংশটা ভেঙে ফেলা জরুরি।”

কথিত এই মাজার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট নেতারা, যাদের বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে হয়।

জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শহীদ মিনারের পেছনে লাগোয়া যে একটি মাজার রয়েছে, এটি আসলে কোনো মাজার নয়। একটি কুচক্রী মহল এখানে মাজার বানানোর চেষ্টা করেছে। এটা কোনো ধর্মীয় প্রতষ্ঠিানও নয়। এটা কিছু লোকের নিয়মিত আড্ডার জায়গা। আপনরা জানেন এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে কী ধরনের কাজ হয়। শহীদ মিনারকে গ্রাস করবার জন্য, শহীদ মিনারকে বিতর্কিত করার জন্য এটি তাদের পায়তারা।’’

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, শহীদ মিনার আগে নাকি মাজার আগে? এটি বহু আগে উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল।

“সম্প্রতি কিছু লোক সেখানে নিয়মিত বসে এটাকে আবার মাজার বানানোর পরিকল্পনা করছে। আমরা মনে করি, নিরাপত্তা বাহিনীর বিষয়টি কঠোরভাবে দেখা উচিত। সেখানে কোনো অনুষ্ঠানে হলে তারা নানা ধরনের জজমা তৈরি করে। কখনো কখনো অনেকটা বিপরীতি অবস্থাও তৈরি হয়।”

একজন-দুজন কর্মচারীর পক্ষে শহীদ মিনার দেখভাল সম্ভব নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “২৪ ঘণ্টা যেহেতু পাহারা দিতে হয়, এখানে ৩-৪ জন কর্মচারী প্রয়োজন।”

মাজার নিয়ে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি রিট করেছিলাম। হাই কোর্ট এটাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে এবং ওখানে বলেছে কবরটা থাকবে। অন্য কিছু থাকবে না।

“পরে বাকি জায়গাটা উদ্ধার করে তৎকালীন উপাচার্যের কাছে চাবি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন ওখানে কেউ কিছু করে থাকলে এটাতো আর আমার কিছু করার নেই। আমি আমার কাজ করেছি। এখন এটা রক্ষাণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।”