প্রবীণদের বিশৃঙ্খলার ভয়, চান ভোটের আলাদা লাইন

“ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা নাই। গতবার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখেছিলাম কয়েকজন বিশৃঙ্খলা করছিল। প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমি নিজেও হেনস্তার শিকার হয়েছি। মনের কষ্টে সেইবার ভোট না দিয়েই ফিরে এসেছিলাম।”

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Jan 2020, 07:22 PM
Updated : 25 Jan 2020, 07:58 PM

২০১৫ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ওই অভিজ্ঞতার পর আর কখনো ঢাকায় ‘ভোট না দেওয়ার’ সিদ্ধান্ত নিয়ে গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে গিয়ে ভোটার হন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের এই বাসিন্দা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৬৭ বছর বয়সী এই ব্যক্তি ১৯৯০ সাল থেকে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের কোয়ার্টারে থাকেন।

আগামী ১ ফেব্রুয়ারি ফের ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ভোটগ্রহণ সামনে রেখে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোট আমাদের কাছে উৎসবের মতো। কিন্তু কেন্দ্রে গিয়ে বিশৃঙ্খলা দেখলে কষ্ট লাগে। ভোটের চেয়ে নিজের নিরাপত্তা বেশি জরুরি। ভোটে কে উঠল, আর কে উঠল না সেটা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। আমি চাই, এবারের নির্বাচনে শৃঙ্খলা আসুক।”

নিউ মার্কেট এলাকার বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেনও (৭০) ভোট কেন্দ্র নিয়ে তার মতো অভিযোগ করেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোটকেন্দ্রে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা হয়। আমাদের মতো বয়স্ক মানুষদের জন্য বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিজেকে রক্ষা করা খুব কষ্টসাধ্য। ঝামেলার মধ্যে সন্তানরা ভোট কেন্দ্রে যেতে দিতে চায় না।”

এবারের নির্বাচনে বিশৃঙ্খলার আঁচ পেলে ভোট দিতে যাবেন না বলে জানান তিনি। চাঁদপুরের মতলবে জন্ম নেওয়া দেলোয়ার দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে নিউ মার্কেট এলাকায় বাস করছেন।

গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই সুষ্ঠুভাবে ভোট দেওয়ার কথা জানান কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী জয়নাল হোসেন।

তবে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত অনেক প্রবীণের মতো তাকেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল বলে জানান তিনি।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রবীণদের জন্য ভোটকেন্দ্রে আলাদা লাইন থাকলে ভালো হত। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কষ্ট পেতে হত না।

প্রবীণ নিবাস কেন্দ্র ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’র চেয়ার‌ম্যান মিল্টন সমাদ্দারও প্রবীণ ভোটারদের জন্য আলাদা লাইন রাখার দাবি করেন।

তিনি বলেন, “ভোটকেন্দ্রে প্রবীণদের জন্য আলাদা কোনো সুযোগ সুবিধাই নাই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।

“এটা বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্তদের জন্য খুব ভোগান্তির বিষয়। এর মধ্যে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা হলে আমি আমার বাবা-মাকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া নিয়ে সংশয়ে থাকি।”

আগে প্রবীণদের ভোটকেন্দ্রে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রার্থীরা নানা উদ্যোগ নিলেও এখন তেমনটা আর দেখা যায় না বলে জানান মিল্টন।

“আগে ভোট উৎসবমুখর ছিল। বাড়ি বাড়ি এসে প্রার্থীরা প্রবীণ ভোটারদের কোলে করে কিংবা বিভিন্ন পরিবহনে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যেতেন। এখন আর তা হয় না।”

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে এবার ভোটগ্রহণ হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন-ইভিএমে। এই যন্ত্রে কীভাবে ভোট দিতে হয়, তা নিয়েও কিছুটা উৎকণ্ঠায় আছেন অনেকে। 

রাজধানীর দক্ষিণ পাইকপাড়া এলাকার আইনুল হক নামে এক প্রবীণ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুনেছি ইভিএম না কি যেন এক মেশিনে ভোট হবে, কিন্তু এই বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই।”

প্রতিবন্ধীদের নিয়ে উদ্বেগ

ভোটকেন্দ্রগুলো ‘প্রতিবন্ধীবান্ধব’ করার দাবি জানিয়েছেন প্রতিবন্ধী বিষয়ক নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ডিজ্যাবিলিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন।

তাদের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “বেশিরভাগ ভোট কেন্দ্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা প্রবেশ করতে পারবে না, একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীর জন্য ভোটকেন্দ্রের নির্ধারিত বুথে পৌঁছানোটাই অনেক বড় চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। ব্যালট পেপারগুলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ব্যবহার করতে পারবে কি না এটিও নিশ্চিত করতে হবে।”

প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি রাজিব শেখ বলেন, “যারা বাক বা শ্রবণ প্রতিবন্ধী তাদের জন্য কোনো সাইন ব্যবহার করা হয়নি। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্যও ব্যবস্থা নেই। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য টেকটাইল ব্যালটের প্রয়োজন, বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য কেন্দ্রগুলোতে সাইন ব্যবহার করা উচিত, এটি হচ্ছে সাংকেতিক চিহ্ন যাতে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীরা দেখামাত্রই বুঝতে পারে নির্ধারিত প্রতিবন্ধীদের বুথ এটি।”

তিনি বলেন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ভোটাররা তাদের পছন্দমতো একজন সহযোগী ব্যক্তি নিতে পারবেন, যিনি তাকে তার পছন্দের প্রতীক দেখিয়ে দেবেন যেখানে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি তার ভোট দিতে পারবেন- এ রকম একটি সুযোগ দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য দেওয়া উচিত।

প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা আরেক সংস্থা রিহ্যাফের সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “আমরা আরও একটা বিষয় খেয়াল করি সেটা হলো জ্যেষ্ঠ নাগরিক ও প্রতিবন্ধী ভোটারদের আলাদা ব্যবস্থা আছে কি না। যেটা আমরা পেয়েছি তা হলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাইনি। কেন্দ্রগুলো প্রতিবন্ধীবান্ধব নয়। নির্বাচন কমিশন থেকে আলাদা উদ্যোগ নেই। প্রার্থীদের পক্ষ থেকে এ বিষয়টা শুধু প্রতিশ্রুতির মধ্যেই থাকে।“

তবে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির নির্বাচন কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ সহায়তায় আলাদাভাবে ভোটদানের ব্যবস্থা করার বিধান রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার বিষয়টি দেখভাল করবেন। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়েছে।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান আলমাস বলেন, “প্রতিবন্ধীরা কেউ কেন্দ্রে আসা মাত্রই দায়িত্বশীল লোকজন আলাদা লাইনে দ্রুততার সাথে বুথকক্ষে নিয়ে যাবেন। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে। জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের বিষয়েও কেউ দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা সহায়তা করবেন।”

এবার নির্বাচনে তিনশ ভোটারের বিপরীতে একটি করে বুথ থাকবে বলে ভোটারদের অসুবিধা হবে না বলে মনে করছেন তিনি।

ঢাকা উত্তরের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নজরুল ইসলামও প্রতিবন্ধীদের ভোট দেওয়ায় বিশেষ লাইনের সুযোগ রাখার কথা বলেছেন।