গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের পাঁচ নম্বর হোল্ডিংয়ের ওই বাড়িতেই ছিল স্প্যানিশ খাবারের ক্যাফে- ‘হলি আর্টজান’ বেকারি। গুলশান লেকের তীরে দোতলা ভবনটির সামনে সবুজ লন বিদেশিদের কাছে ছিল দারুণ জনপ্রিয়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে বদলে যায় সব।
দেশের ইতিহাসে ভয়াবহ সেই জঙ্গি হামলার পর মালিক নিজেই সেখানে থাকার জন্য গুছিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু এখনও দিনের অধিকাংশ সময় বাড়ির গেইটে তালা ঝুলতে দেখা যায়। মালিক নিয়মিত না থাকলেও বাড়িতে প্রবেশে রয়েছে কড়াকড়ি।
নিরাপত্তাকর্মী-মালি মিলিয়ে ১০ জন এই বাড়ি ও পাশের ক্লিনিকে দায়িত্ব পালন করলেও মালিকের ‘নিষেধাজ্ঞার’ কারণে সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে কেউই মুখ খুলতে চাইলেন না।
হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ সেই জঙ্গি হামলার পর মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে কয়েক মাস আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল বাড়িটি। ঘটনার পাঁচ মাস পর ওই বছরের নভেম্বরে বাড়িটি বুঝিয়ে দেওয়া হয় মালিক সামিরা আহমেদ ও তার স্বামী সাদাত মেহেদীকে।
১৯৭৯ সালে ‘আবাসিক ভবন কাম ক্লিনিক গড়ে তোলার জন্য ’ ডা. সুরাইয়া জাবিনকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল বাড়িটি। ১৯৮২ সালে ওই প্লটের একপাশে গড়ে তোলা হয় লেকভিউ ক্লিনিক।
সুরাইয়ার মৃত্যুর পর প্লটের মালিক হন তার দুই মেয়ে সামিরা ও সারা আহমেদ। তাদের দুটি প্লট এক করে উত্তর পাশের দোতলা ভবনটিতে ২০১৪ সালে গড়ে তোলা হয় হলি আর্টিজান বেকারি, যা পরিচালানায় ছিলেন সাদাত মেহেদী ও তার এক বন্ধু। আর দক্ষিণপাশে থাকে লেকভিউ ক্লিনিক।
জঙ্গি হামলার আগে বাড়িটি পূর্বপাশ ঘেঁষে গুলশান লেকের পাড় দিয়ে পায়ে পায়ে হাঁটার একটি রাস্তা ছিল, হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেটি বন্ধ করে দেয়। এরপর তা আর খুলে দেওয়া হয়নি।
হামলার পর বাড়ি বুঝে নিয়ে মেরামত করে নিজেরাই থাকার জন্য গোছগাছ করেন সাদাত মেহেদী। বাড়িটির সামনে সামনে ইস্পাতের উঁচু বেষ্টনী দেওয়া হয়। তা এখনও আগের মতই আছে। হামলার আগে বাড়িটির আঙ্গিণায় বসার যে বিশেষ ব্যবস্থা ছিল তাও এখন আর নেই।
শুক্রবার (২২ নভেম্বর) বাড়িটির সামনে গিয়ে দেখা গেল প্রধান গেইটে কালো পোশাকধারী নিরাপত্তাকর্মীদের পাহারা। প্রতিবেদককে দেখে তাদের দুইজন নিরাপত্তাকর্মী নুরুজ্জামান ও মো. হোসেন এগিয়ে আসেন।
তারা জানালেন, পাশের লেকভিউ ক্লিনিকের ৩২ বছর পূর্তি উপলক্ষে হামলার শিকার বাড়ির ভেতর অতিথিদের নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল সেদিন; এ উপলক্ষে বাড়ির মালিকও সেখানে এসছিলেন।
আরেক নিরাপত্তাকর্মী মো. হোসেন বলেন, “ক্লিনিকের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান উপলক্ষে সার ও ম্যাডাম এসেছিলেন। বিকালে অনুষ্ঠান শেষে তারা চলে গেছেন।”
তিনি বলেন, “এই বাড়িতে বাইরের কাউকে ঢুকতে মালিকের মানা রয়েছে। যে কারণে আমরা কাউকে প্রবেশ করতে দিতে পারি না। বাড়ির সামনে গিয়ে ছবি তুলতেও মানা রয়েছে।”
আরেক নিরাপত্তাকর্মী নুরুজ্জামান বলেন, “ম্যাডাম-স্যার এই বাড়ি থাকার উপযোগী করেছেন। ভেতরে বেশকিছু আসবাবপত্র বসানো হয়েছে। তবে উনারা সেখানে নিয়মিত থাকেন না। বনানী এলাকায় তাদের আরেকটি ফ্ল্যাট রয়েছে, সেখানে উনারা বেশি থাকেন। এখানে হঠাৎ হঠাৎ আসেন।”
রায়কে ঘিরে বাড়ির মালিক সামিরা আহমেদের যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। তবে ফোনে কথা হয় সামিরার স্বামী স্বামী সাদাত মেহেদীর সঙ্গে।
বাড়ির বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে সংক্ষেপে তিনি বলেন, “এ বাড়িতে আমরা আর কোনো বেকারি বা রেস্টুরেন্ট রাখিনি। কেবল সেখানে বসবাসের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
তবে মামলার রায় নিয়ে তিনিও কথা বলতে রাজি হননি।
নতুন জায়গায় হলি আর্টিজান
হামলার ছয় মাস পর গুলশান এভিনিউর র্যাংগস আর্কেডের দ্বিতীয় তলায় নতুন পরিসরে চালু হয় হলি আর্টিজান বেকারি। সেখানে ২০ জনের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নতুন করে চালুর পর থেকে বেকারিটি ঠিক আগের মতো না চললেও ক্রেতাদের অধিকাংশ বিদেশি, যারা বিভিন্ন দেশের দূতাবাস বা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের লোকজন বলে বেকারির কর্মীরা জানান।
নাম প্রকাশ না করে এক কর্মী বলেন, “নতুন করে হলি আর্টিজান বেকারি চালুর পর আমাদের আগের অনেক ক্রেতাই এখানে আসেন। বিক্রিও ভাল। সাধারণত আগে থেকে অনেকে খাবার অর্ডার করেন, সেগুলো তৈরি করে রাখা হয়। আবার বহু আইটেম অর্ডার ছাড়াও করা থাকে। যার যার পছন্দ মতো নিয়ে যান।”
সেদিনের ঘটনা
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে জঙ্গি হামলার যারা প্রত্যক্ষদর্শী বা পাশ থেকে আঁচ করেছেন তারা সেদিনের ঘটনা মনে করলে এখনও আঁতকে ওঠন।
হামলার দিনের কথা স্মরণ করে লেকভিউ ক্লিনিকের ফ্রন্ট ডেস্ক এক্সিকিউটিভ আয়ান মো. বিজয় বলেন, “সেদিন সন্ধ্যার পর হঠাৎ গোলাগুলির শব্দে আমরা হতচকিত হয়ে যাই। আমাদের ক্লিনিকে সেদিন সাত-আটজন রোগী ছিল। তারা সবাই কেবিনে ছিল। প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর রোগীদের সবাইকে মেঝেতে শুইয়ে দেওয়া হয়, যদি গুলি এসে জানালার কাচে লাগে.. সেই ভয়ে। সারা রাত কেমন করে কেটেছে, আমরাই জানি।”
পরদিন কমান্ডো অভিযানেও সময় ক্লিনিক থেকে সবাইকে বের করে নেওয়া হয়েছিল বলে জানান তিনি।
নতুন চালু করা হলি আর্টিজান বেকারিতে কাজ করেন জঙ্গি হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া ছয়জন।
তাদের একজন মো. সাঈদের কাছে হামলার দিনের কথা জানতে চাইলে বলেন, “আসলে আমি সেদিনের কথা আর মনে করতে চাই না। ভুলে থাকতে চাই। মনে করলে হয়তো অনেক কিছু বলা যেত। এখন যেহেতু কাজ করে দিন কাটে সেটাই ভালো থাকার একটা ব্যবস্থা।”
এছাড়া গণমাধ্যমের সাথে সেদিনের ঘটনার নিয়ে কথা বলতে ‘মালিকের নিষেধ’ আছে বলেও জানান তিনি।
বাড়িটির ব্যবস্থাপক আনিসুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়, সাড়ে তিন বছর আগের হামলার প্রভাব এখনও রয়েছে কিনা।
তিনি বলেন, “সেদিনের ঘটনার পর নিরাপত্তা জোরদার করা হলেও মানুষের মনের আতঙ্ক কিন্তু কাটেনি। ওই ঘটনার পর পুরনো ভাড়াটেদের অনেকে এই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন।
“তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া একেবারে কমে গেছে। আমরা যেখানে সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকায় অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া দিতাম, সেখানে এখন এক লাখ টাকাতেও ভাড়া নিতে চান না অনেকে। এর কমেও ভাড়া দিয়ে দিতে হচ্ছে।”
তবে জঙ্গি হামলার পর গুলশান এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আরও বেড়েছে, বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা দিন-রাত টহল দেয় বলে জানান তিনি।