দুঃসহ সেই স্মৃতি এখন ভুলে থাকতেই চান তারা ঝড় তোলা সেই হামলার পর তিন বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে; বাড়ির মালিক নিজেই সংস্কার করে সপরিবারে এখন থাকছেন সেখানে। তবে ওই জঙ্গি হামলা নিয়ে কথা বলতে চান না তিনি, তাই গণমাধ্যমকর্মীদের ঢোকায় রয়েছে কড়াকড়ি।
সেদিনের হলি আর্টিজান বেকারিটিকেও এখন ওই বাড়িতে পাওয়া যাবে না। গুলশান এভিনিউর র্যাংগস আর্কেডের দ্বিতীয় তলায় এখন চলছে খাবারের দোকানটি। সেই বেকারির কর্মীরাও মনে ফিরিয়ে আনতে চান না সেই স্মৃতি।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতটি দুঃসহ হয়ে এসেছিল হলি আর্টিজান বেকারির কর্মীদের জন্য, যা বেদনায়ক একটি অধ্যায় গোটা বাংলাদেশের জন্যও।
দেশি-বিদেশি অতিথিদের নিয়ে ওই সন্ধ্যায় যখন সরব গুলশান লেক লাগোয়া হলি আর্টিজান বেকারি, তখন সশস্ত্র পাঁচ জঙ্গি ঢুকে পড়ে সেখানে, অস্ত্রের মুখে সবাই জিম্মি করে তারা। শুনে সেখানে ঢুকতে গিয়ে জঙ্গিদের হামলায় নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা।
তারপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেষ্টনির মধ্যে রাতভর চলে আইএস দ্বারা উদ্বুদ্ধ ওই তরুণ জঙ্গিদের তাণ্ডব। ভোরে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে তারা মারা পড়ার পর দেখা যায়, রাতে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে গলাকেটে হত্যা করে জঙ্গিরা।
গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আলামত হিসেবে কয়েক মাস আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল বাড়িটি। পাঁচ মাস পর নভেম্বরে বাড়িটি বুঝিয়ে দেওয়া হয় এর মালিক সামিরা আহমেদ ও সাদাত মেহেদীকে।
১৯৭৯ সালে ‘আবাসিক ভবন কাম ক্লিনিক গড়ে তোলার জন্য’ ডা. সুরাইয়া জাবিনকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল বাড়িটি। ১৯৮২ সালে ওই প্লটের একপাশে গড়ে তোলা হয় লেকভিউ ক্লিনিক।
সুরাইয়ার মৃত্যুর পর প্লটের মালিক হন তার দুই মেয়ে সামিরা ও সারা আহমেদ। তাদের দুটি প্লট এক করে উত্তর পাশের দোতলা ভবনটিতে ২০১৪ সালে গড়ে তোলা হয় হলি আর্টিজান বেকারি, যা পরিচালানায় ছিলেন সাদাত মেহেদী ও তার এক বন্ধু। আর দক্ষিণপাশে থাকে লেকভিউ ক্লিনিকটি।
জঙ্গি হামলার পর বাড়ি বুঝে নিয়ে মেরামত করে নিজেরাই থাকার জন্য গোছগাছ শুরু করেন সাদাত।
হামলার তৃতীয় বছর পূর্তির আগের দিন রোববার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, সেদিন নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বাড়ির সামনে তৈরি করা হচ্ছে অস্থায়ী মঞ্চ।
দোতলা বাড়িটির বাইরের অবকাঠামো এখনও আগের মতোই আছে। তবে বাড়ির সামনের অংশে টিন দিয়ে উঁচু প্রাচীর দেওয়া হয়েছে। কয়েকজন শ্রমিক বাড়ির দেয়ালে রং লাগানোর কাজ করছিলেন।
হামলার আগে বাড়িটির পূর্বপাশে লেকের পাড় দিয়ে হাঁটার পথ থাকলেও হামলার পর সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তা এখনও খোলা হয়নি।
বাড়ির প্রধান ফটকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় নিরাপত্তাকর্মীকে। ঢুকতে চাইলে তিনি বলেন, কাউকে ঢুকতে দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘মালিকের কড়াকড়ি’ রয়েছে।
নিরাপত্তাকর্মী নুরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই বাড়িতে এখন স্যার-ম্যাডাম বসবাস করেন। উনাদের আত্মীয়-স্বজন হঠাৎ হঠাৎ আসেন। তবে বাইরের মানুষ তেমন কেউ আসেন না।”
পাশের বাড়ির এক নিরাপত্তাকর্মী বলেন, “এই বাড়িটি দেখতে প্রতিদিনই বহু বিদেশি আসে। তিনজন-চারজনের গ্রুপে তারা এসে এই বাড়ির বাইরে থেকে দেখে চলে যায়।”
সাদাত মেহেদী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত দুই বারের মতো এবারও হামলার বার্ষিকী উপলক্ষে সোমবার সকাল ১০ থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত বাড়ির প্রাঙ্গণ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এ সময়ের মধ্যে যে কেউ হামলায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারবেন।”
জঙ্গি হামলার পর কয়েক মাস লেকভিউ ক্লিনিকটি বন্ধ থাকলেও এখন সেখানে রোগী ও তাদের স্বজনদের যাতায়াত চোখে পড়ে।
ক্লিনিকের অভ্যর্থনাকর্মী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, “এখানে মূলত বিকালে কনসালটেন্ট বসেন, উনারা রোগী দেখে ব্যবস্থাপত্র দেন।
“আর হাসপাতালে নিয়মিত একজন ডাক্তার আছেন, ইমার্জেন্সিতে আছেন আরেকজন ডাক্তার। এই মুহূর্তে এখানে পাঁচজন রোগী ভর্তি আছেন।”
হামলার পর পর আশপাশের বাড়িগুলো থেকে ভাড়াটিয়াদের অনেকে বাসা ছেড়ে চলে গেলেও এখন আগের চিত্রই ফিরে এসেছে।
হলি আর্টিজান লাগোয়া ‘সুভাস্তু সেতারা’ নামে বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী আনোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই বিল্ডিংয়ে ১৮টি ফ্ল্যাট আছে। গত মাসে একটি ফ্ল্যাট খালি হয়েছে। তবে সেটাও ভাড়া হয়ে যাবে। এখন আর কারও মধ্যে কোনো ভয় কাজ করে না।”
ওই ভবনে এখন বাংলাদেশি ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিক থাকছেন।
ওই ভবনের সামনের ‘ফ্লোরালিয়া’ ভবনের নিরাপত্তাকর্মী রেজাউল করিম বলেন, তাদের ভবনেও কোনো ফ্ল্যাট খালি নেই। ভবনটির ১০টি ফ্ল্যাটের সবগুলোতেই ভাড়াটিয়া আছেন।
জঙ্গি হামলার ছয় মাস পর র্যাংগস আর্কেডের দ্বিতীয় তলায় স্বল্প পরিসরে চালু করা হয় হলি আর্টিজান বেকারি। ২০ জন এক সঙ্গে বসার ব্যবস্থা করে নতুন করে চালু হওয়ার পর থেকে এ বেকারি আর বড় করা হয়নি।
রোববার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বেকারিতে কর্মীরা ব্যস্ত, কথা বলার ফুসরত নেই কারও। ভেতরে বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা বসে আছেন। বাইরে থেকেও অনেকে এসে বিভিন্ন খাবার ‘অর্ডার’ করে নিয়ে যাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেই হামলার পর বেঁচে যাওয়া কর্মচারীদের চারজন সেখানে এখনও কাজ করেন।
তাদের একজন মো. সাঈদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বেকারি ‘ভালোই’ চলছে। আগের মতো এখনও বিদেশিরাই তাদের প্রধান ক্রেতা।
হামলার ঘটনার দিনের কথা মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন, “ভাই, ওই দিনের কথা আর মনে করতে চাই না। সেই ঘটনা ভুলে থাকতে পারলে ভালো থাকতে পারব।”