বোরহানউদ্দিনে সমাবেশে সায় ছিল পুলিশের, ছিল না প্রস্তুতি

ফেইসবুকে কথিত ‘ধর্ম অবমাননার’ প্রতিবাদে বোরহানউদ্দিনে ডাকা সমাবেশ আয়োজনে অনুমতি ছিল না- এমন বক্তব্য এখন পুলিশ দিলেও ছোট আকারের সমাবেশে সায় ছিল তাদের।

মাসুম বিল্লাহ ভোলা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Oct 2019, 03:58 AM
Updated : 25 Oct 2019, 04:20 AM

এমন আয়োজনের মৌখিক অনুমতি দিয়ে ঠেকানোর প্রস্তুতি ছাড়া সমাবেশস্থলে গিয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এর মধ্যে পূর্বনির্ধারিত সময়ের আগে সেটি বন্ধ করে দিয়ে জনরোষের মুখে পড়েন তারা।

অন্যদিকে, সমাবেশের আয়োজক ‘তৌহিদী জনতার’ সংগঠক মাওলানারা সেটিকে ছোট পরিসরে না রেখে উল্টো বড় করেছেন। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি আর তাদের নিয়ন্ত্রণেও ছিল না।

সমাবেশের আগের রাতে ‘তৌহিদী জনতা’র সংগঠক ও প্রশাসনের বৈঠকের উপস্থিত কমপক্ষে ছয়জন ব্যক্তি এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এমন তথ্য।

এক হিন্দু তরুণের ফেইসবুক আইডি ‘হ্যাক’ করে ‘অবমাননাকর’ পোস্ট ছড়ানোর পর গত রোববার বোরহানউদ্দিনের ঈদগাঁ মাঠে সমাবেশ ডেকেছিল ‘মুসলিম তৌহিদী জনতা’। ওই সমাবেশ থেকে পুলিশের উপর হামলার পর চলে গুলি, নিহত হন চারজন।

এই সংঘর্ষ ও প্রাণহানি দেশ-বিদেশের সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হলেও অনেকটা আড়ালে থেকে যায় ওই সংঘর্ষের পর পাশের হিন্দু পল্লীতে ভাংচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা।

প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে সিদ্ধান্তের বিষয়ে বোরহানউদ্দিন উপজেলার বাটামারার পীর মাওলানা মুহিববুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিদ্ধান্ত হয়েছিল সমাবেশ হবে না এবং প্রত্যেকে গিয়ে তার এলাকায় জানিয়ে দেবে।

“তবে যারা সমাবেশ স্থগিতের বিষয় জানবে না এবং যদি তারা সমাবেশস্থলে উপস্থিত হয়েই যায়, তাহলে তাদেরকে বুঝিয়ে পাঠানোর একটা কথা উঠেছিল। সমাবেশে বোঝানোর এই কাজ করবেন আলেম সমাজের প্রতিনিধি এবং প্রশাসনের লোক। সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন আমি মনে করিনি।”

তার এমন বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় ভোলার পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সারের কথায়ও। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন, “আমরা কথা বলব, এমন কথা ছিল না। হুজুররা তাদের বুঝিয়ে পাঠাবেন বলে কথা হয়।”

পরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেওয়া প্রসঙ্গে এসপি বলেন, “ওনাদের (মাওলানাদের) অনুরোধে আমরা বক্তব্য দিয়েছি। পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেছি।”

শনিবার থানায় অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্তে হয়েছিল, সমাবেশ স্থগিতের বিষয়টি মাওলানারা সভা শেষে ও নিজেদের মসজিদে ফজরের নামাজের সময় জানিয়ে দেবেন। কিন্তু তারা সেটি করেননি। উল্টো মঞ্চ তৈরি এবং ১৭টি মাইক লাগানো হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঈদগাহ মসজিদের ইমাম জালাল উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাত ১২টায় মিটিং শেষ হয়, অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় জানানো সম্ভব হয়নি।”
আগের দিন মসজিদের মাইকে সমাবেশের ঘোষণা দিলেও স্থগিতের বিষয় জানানো হয়নি কেন- এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

সমাবেশ আয়োজকদের একজন বোরহানউদ্দিন কামিল মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা ফয়জুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুলিশ ও প্রশাসনের লোকেরা যখন আসে, তখন আমরা শুরুতে তাদের নিয়ে বসি। কাদের পক্ষে কারা বক্তব্য দেবেন, তা ঠিক হয়।”

রোববার মানুষ জমায়েত হলে তাদের উদ্দেশে প্রশাসন ও আলেম সমাজের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেবেন, এমন সিদ্ধান্ত বৈঠকে হয়েছিল বলে জানান বোরহানউদ্দিন পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলামও।

বোরহানউদ্দিন উপজেলারই বাসিন্দা বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য শুভর ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট ‘হ্যাক’ করে ’ধর্ম অবমাননাকর’ স্ট্যাটাস ও মেসেঞ্জারে বার্তা পাঠানোর বিষয়টি সেখানে জানাজানি হয় শুক্রবার।

ওই রাতেই ফেইসবুক ‘হ্যাক’ হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে বোরহানউদ্দিন থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন ওই যুবক। এ ঘটনায় শনিবার সকালে বিক্ষোভ দেখায় এলাকাবাসী।

এরপর বিকালে ‘তৌহিদি জনতা’র ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ থেকে রোববার সকাল ১১টায় বোরহানউদ্দিন ঈদগাহ মাঠে সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়।

শুভর ফাঁসির দাবিতে এলাকায় উত্তাপের মধ্যে শনিবার রাতে সমাবেশ আহ্বানকারী ও মাওলানাদের সঙ্গে বৈঠকে বসে প্রশাসন।

প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে ধর্মীয় নেতারা আশ্বস্ত হয়েছিলেন জানিয়ে মাওলানা ফয়জুল বলেন, “স্মারকলিপি দেওয়ার কথা ছিল, আমরা সেটি সেই রাতেই ডিসি সাহেবের হাতে তুলে দিয়েছি। আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু মানুষজনকে আশ্বস্ত করার স্বার্থে পরের দিনের সমাবেশ করার কথা ছিল।”

রোববারের সমাবেশ ছোট পরিসরে থাকা এবং মিছিল না হওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল, বলেন তিনি।

সমাবেশ এবং সংঘর্ষ

প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও সমাবেশের সংগঠকদের সঙ্গে কথা বলে এবং ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে সেদিন ভোলার বোরহানউদ্দিন ঈদগাহ মাঠে সংঘর্ষের আগে-পরে কী ঘটেছিল, তা বোঝার চেষ্টা করেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

তাতে জানা যায়, সমাবেশ ঘিরে সকাল ৯টা থেকে মাঠে উপস্থিত হতে শুরু করে এলাকাবাসী। সাড়ে ৯টার কিছু পরে সেখানে হাজির হন পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি একেএম এহসান উল্লাহ, ভোলার এসপি সরকার মোহাম্মদ কায়সার, বোরহানউদ্দিন উপজেলার ভারপ্রাপ্ত ইউএনও হাসিবুল হাসান রুমি।

আগের বড় সমাবেশ আয়োজনে না করার বিষয়ে সম্মতি দিলেও মঞ্চ বানানোর পাশাপাশি অন্তত ১৭টি মাইক সেখানে লাগানো হয়। মসজিদে সমাবেশ আয়োজকদের সঙ্গে প্রশাসনের বৈঠকের পর বসে কারা বক্তব্য দেবে, তা ঠিক হয়।

ওই সমাবেশস্থলের ঠিক পেছনে বাড়ি কুয়েত প্রবাসী আব্দুল হাইয়ের। ‘কী হয় তা দেখার জন্য’ মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন বলে জানান তিনি।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আব্দুল হাই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সকাল ১০টার দিকে সমাবেশ শুরু হয়ে তা সাড়ে ১০টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। যারা সেখানে উপস্থিত ছিল তাদের অধিকাংশ মাঠ ছেড়ে যায়।

“এ সময় সেখানে উপস্থিত লোকজন প্রশাসন ও হুজুরদের উদ্দেশে হট্টগোল করতে থাকে। এর মধ্যে উত্তর বাসস্ট্যান্ড এবং বোরহানউদ্দিন বাজারের দিক থেকে দুইটা মিছিল এসে আবার মাঠ পূর্ণ হয়ে যায়।”

নির্ধারিত সময়ের আগে সমাবেশ শেষ করে দেওয়াই হট্টগোলের মূল বিষয় ছিল বলে জানান ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী।

মোহাম্মদ ফজলু নামে এক শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরিস্থিতি খারাপ দেখে পেছনে স্কুলের ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নিই। দেখি মাঠের মধ্যে পুলিশ সদস্যদের ঘেরাও করে ফেলছে। পরে পুলিশ সদস্যরা মসজিদের উপরের তলার দুইটি কক্ষে গিয়ে অবস্থান নেয়।”

সংঘর্ষের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় সাংবাদিক এইচ এম এরশাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মসজিদের উপরের দুই রুমে দৌড়ে এসে পুলিশ কর্মকর্তা ও অন্য সদস্যরা অবস্থান নেয়। এ সময় নিচ থেকে ইটপাটকেল প্রচুর ইট-পাটকেল ছোড়া হয়।”

তিনি জানান, তখন উত্তেজিত লোকজন উপরের দিকে চলে আসতে চাইলে মাদ্রাসার ছাত্রদের বাধার মুখে পড়ে এবং তখন পুলিশ ফাঁকা গুলি ‍ছুড়লে দূরে সরে যায়।”

ঘটনার কয়েকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, মাঠের মধ্যে হট্টগোল আর মসজিদের দোতলার দিকে ইট-পাটকেল ছোড়ার এক পর্যায়ে মাদ্রাসা ছাত্রদের ব্যারিকেড ভেঙে পুলিশের আশ্রয়স্থলে চলে আসে মানুষ।

এ সময় লাঠি, ইট ও কাঠের লাকড়ি নিয়ে মসজিদের দোতলার দুটি কক্ষ ভাঙার চেষ্টা চালায় কয়েকজন যুবক। এ সময় একজন পুলিশ সদস্য আহত হলে প্রতিরোধে করা শুরু করে পুলিশ।

প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক এরশাদ বলেন, “পুলিশকে এত ধৈর্য ধরতে আমি কখনও দেখিনি। পুলিশ শেষ পর্যন্ত নিরূপায় হয়ে গুলি ছোড়া শুরু করে।”

ওই আক্রমণকারীরা বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী কি না, তা খতিয়ে দেখা এবং তাদের চিহ্নিতকরণের কাজ চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভিডিও ফুটেজে কিছু ‘চেনা মুখ’ শনাক্ত করা গেছে।

পুলিশের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন

সমাবেশের অনুমতি না দিলে তা ঠেকানোর জন্য পুলিশের যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল না বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

বোরহানউদ্দিনের একজন কলেজ শিক্ষক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভিডিও ফুটেজ দেখলেই বুঝবেন, মাত্র ১৫ থেকে ২০ জন পুলিশ সদস্য ছিল। যে পরিস্থিতি এলাকায় ছিল, তা প্রতিরোধে পুলিশের প্রস্তুতি কোনোভাবে যথেষ্ট ছিল না। এ কারণে গুলি করে থামাতে হয়েছে তাদের।”

তিনি আরও বলেন, ”যত সময় ধরে ঝামেলা আর সংঘর্ষ হয়েছে, তাতে খুব সহজেই ভোলা থেকে অতিরিক্ত ফোর্স আনা যেত। কিন্তু তা আমরা দেখিনি।”

তবে প্রস্তুতি ‘যথেষ্ট ছিল’ বলে দাবি করেছেন ভোলার পুলিশ সুপার সরকার কায়সার।

তিনি বলেন, “যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল না-, তা ঠিক নয়। আমাদের ৪০ জনের ফোর্স ছিল। ২০ জন সামনে এবং ২০ জন পেছনে। কিন্তু মানুষের উপস্থিতির কারণে পেছনের ২০ জন ইনএক্টিভ হয়ে গিয়েছিল।”

অতিরিক্ত পুলিশ আনার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “অতিরিক্ত ফোর্স আসেনি, তা ঠিক নয়। তারা এসেছিল, কিন্তু উত্তর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মানুষের বাধার কারণে আসতে পারেনি।”

সমাবেশে উপজেলা ছাত্রদল সভাপতিও

সেদিনের সমাবেশে দেখা গেছে বোরহানউদ্দিন উপজেলা ছাত্রদলের সভাপতি আশরাফ আলী সবুজকেও।

উপজেলা ছাত্রদলের সভাপতি আশরাফ আলী সবুজ

ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ভোলার পুলিশ সুপার যখন সমবেতদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন একজন সেটা সেলফি মুডে ভিডিও করছেন। সেই ভিডিওতে ধরা পড়ে সবুজের মুখ।

এসপির বক্তব্যে বিপ্লব চন্দ্র শুভর নাম আসলে, সেদিকে ইঙ্গিত করে সবুজ স্বগতোক্তি করছিলেন, “ওরে গুলি করে মারো না কা?”

সমাবেশে যোগ দেওয়ার বিষয় জানাজানি হওয়ার পর গা ঢাকা দিয়েছেন সবুজ। তার মোবাইল ফোনটিও রয়েছে বন্ধ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভোলা জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আল আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বিষয়টি আমি এখনও জানি না। জানার পর তার বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে যদি কেন্দ্রীয় কমিটি নির্দেশনা দেয়, তা ব্যবস্থা নেব।”

দোয়া মাহফিল স্থগিত

নিহতদের স্মরণে শুক্রবারের সর্বদলীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদের ব্যানারে যে দোয়া মাহফিল ডাকা হয়েছিল, তা স্থগিত হয়েছে।

বৃহস্পতিবার রাতে সংগঠনটির যুগ্ম সদস্য সচিব মাওলানা মিজানুর রহমান জানান, প্রশাসনের অনুমতি না পাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।

“গত কয়েক দিনের আলোচনায় আমাদেরকে শুক্রবারের দোয়া মাহফিলের মৌখিক অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। আমরা সে অনুযায়ী শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানটি করার প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। কিন্তু আজ বিকেলে আমরা জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অনুমতি চাইলে তিনি আমাদেরকে অনুমতি দেননি।

“বরং উল্টো শুক্রবার ভোলায় সকল ধরনের সভা-সমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রাতে আমাদের কাছে একটি চিঠি পাঠায়। এমতাবস্থায় আমরা আমাদের দোয়া মাহফিল স্থগিত করেছি।”