সম্রাটসহ যুবলীগের ৪ নেতা লাপাত্তা

ঢাকার ক্লাবগুলোতে অবৈধ ক্যাসিনোর সঙ্গে যুবলীগ নেতাদের জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর সংগঠনটির চার নেতা গেছেন আত্মগোপনে।

কাজী মোবারক হোসেন নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Sept 2019, 06:52 PM
Updated : 3 Oct 2019, 03:37 PM

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটসহ এই নেতাদের খোঁজ মিলছে না কোথাও; কার্যালয়েও তারা যাচ্ছেন না, বাড়িতেও তাদের পাওয়া যাচ্ছে না বলে যুবলীগের কর্মীরা জানিয়েছেন।

ক্যাসিনো বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে লাপাত্তা এই যুবলীগ নেতারা কোথায়, তা বলতে পারছেন না সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদও।

গত বুধবার ঢাকার মতিঝিলের ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাব এবং মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রে র‌্যাবের অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো মেলার পাশাপাশি সেগুলো পরিচালনায় যুবলীগ নেতাদের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ পায়।

ওই দিনই গ্রেপ্তার করা হয় যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে, পরদিন কলাবাগান ক্লাব থেকে গ্রেপ্তার করা হয় কৃষক লীগের নেতা শফিকুল আলম ফিরোজকে। দুদিন পর গ্রেপ্তার করা হয় ঠিকাদার জি এম শামীমকে, যিনিও যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দিতেন।

সহযোগী সংগঠন যুবলীগের নেতাদের চাঁদাবাজি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার অসন্তোষ প্রকাশ পাওয়ার পরপরই জুয়ার আখড়া বন্ধে এই অভিযান শুরু হয়।

এই অভিযান চালিয়ে যেতে এবং অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব অত্যন্ত কঠোর- এই বার্তা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছ থেকে আসার পর আত্মগোপনে গেছেন যুবলীগের প্রভাবশালী চার নেতা।

সম্রাট ছাড়া অন্য চারজন হলেন- যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বকুল এবং ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মতিঝিলের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোমিনুল হক সাঈদ।

যুবলীগকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন ক্লাবে ক্যাসিনো চালানোর সঙ্গে জড়িত থাকায় গ্রেপ্তার এড়াতে গা ঢাকা দিয়েছেন এই নেতারা।

‘ক্যাসিনো’ চালানোর অভিযোগে যুবলীগ নেতা খালেদ ভূঁইয়া গ্রেপ্তার

  আরও তিন ক্লাবে অভিযান, ‘জুয়ার’ ২৪ লাখ টাকা উদ্ধার

কলাবাগানেও ‘ক্যাসিনো ছিল’, অস্ত্রসহ সভাপতি গ্রেপ্তার

ক্ষুব্ধ যুবলীগ চেয়ারম্যান দেখছেন ‘ষড়যন্ত্র’  

হাজারখানেক নেতাকর্মী নিয়ে মধ্যরাতে যুবলীগ অফিসে সম্রাট

প্রধানমন্ত্রী বলে গেছেন অভিযান যেন চলে: কাদের

ক্যাসিনোর টাকার ভাগ কে কে পেত, সে খোঁজও চলছে: কাদের  

বুধবার অভিযান শুরুর দিন খালেদ ভূইয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর সম্রাট সমর্থকদের নিয়ে তার কাকরাইলের কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন। রাতভর সেখানেই ছিলেন তিনি।

এরপর থেকে সম্রাট কার্যালয়ে রয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এলেও এখন তিনি সেখানে নেই বলে জানা গেছে। তিনি কোথায় আছেন, তাও কেউ বলতে পারছে না।

সম্রাটের ঘনিষ্ঠ একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সম্রাট ভাই শনিবার সকাল থেকেই অফিসে আসেন না। কোথায় আছেন, কেউ বলতে পারছেন না।”

বাসায় আছেন কি না- জানতে চাইলে এই যুবলীগ নেতা বলে, “আমরা অফিসে না পেয়ে বাসয় গিয়েছিলাম,  ওখানেও ভাই নাই।”

কাকরাইলের যুবলীগ কার্যালয়ে রোববার সন্ধ্যায় গেলে কার্যালয়ের পাহারাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্যার (সম্রাট) সকালে বের হয়েছেন, এখনও আসেননি।”

সোমবার সন্ধ্যায় যোগাযোগ করলেও একই কথা বলেন ওই পাহারাদার।

অভিযান শুরুর পর কাকরাইলের কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, এখন সেখানে নেই তিনি

অভিযানের সময় মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রের ভেতরে সম্রাটের বিশাল ছবি দেখা গিয়েছিল। ওই ক্লাবের ক্যাসিনো তিনি চালাতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় যে ক’টি ক্যাসিনো চলছিল, তা থেকেও প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা সম্রাটের কাছে আসত বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।

যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দরপত্র থেকে কমিশন এবং সংগঠনের বিভিন্ন কমিটিতে পদ-বাণিজ্য করে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে।

শনিবার বিকাল থেকে খবর নেই কাজী আনিসেরও। দলীয় কার্যালয়ে তিনি যাচ্ছেন না, বাড়িতেও নেই তিনি।

যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সরদার মোহাম্মদ আলী মিন্টু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আনিস যুবলীগের কমিটি বিক্রি করে, চাঁদাবাজি, দরপত্র থেকে কমিশন নিয়ে অবৈধ ভাবে বিপুল পরিমাণে সম্পদ বানিয়েছে। যার ভয়ে এখন সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।”

মিন্টু বলেন, “যুবলীগের কেন্দ্রীয় অফিসে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে ২০০৫ কাজ শুরু করে আনিস। সাত বছর পর কর্মচারী থেকে কেন্দ্রীয় যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক পদে বসে। এখন সে একাধিক গাড়ি-বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমির মালিক।”

তিনি বলেন, “কম্পিউটারে নিয়মিত সারা দেশের যুবলীগ কমিটির তালিকা তৈরি করতে গিয়ে সব তথ্য তার মুখস্থ।  একারণে চেয়ারম্যানের (যুবলীগ প্রধান) ঘনিষ্ঠ হয়ে যান তিনি।

“২০১২ সালে যুবলীগের নতুন কমিটি গঠনের সময় আনিসকে উপ-দপ্তর সম্পাদক করা হয়। পরে দপ্তর সম্পাদক পদটি খালি থাকায় ছয় মাসের মধ্যেই এই পদ পায় আনিস।”

মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বকুল ইয়ংমেনস ক্লাবের সভাপতি খালেদ ভূঁইয়ার সব ধরনের কাজ দেখভাল করতেন বলে জানিয়েছেন যুবলীগের একাধিক নেতা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণের এক নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফকিরাপুলের ক্লাবের টাকা উঠানো থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ খালেদের সকল কাজের সঙ্গে বকুল জড়িত।”

বকুল কোথায়- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “খালেদের ক্লাবে অভিযানের পর থেকেই আত্মগোপনে গেছে বকুল।”

মিজানুর রহমান বকুলের মোবাইল ফোনও বন্ধই পাওয়া যাচ্ছে।

এমন ক্যাসিনো চলছিল বিভিন্ন ক্লাবে, যার নিয়ন্ত্রণ ছিল যুবলীগের নেতাদের হাতে

ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোমিনুল হক সাঈদও এখন পলাতক। বলা হচ্ছে, ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনোটি তার নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। সাঈদের মোবাইল ফোনও বন্ধ।

যুবলীগের এক নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাঈদ সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন, শনিবার তার ফেরার কথা ছিল। কিন্তু অভিযানের কথা শুনে আর আসেনি।”

যুবলীগ নেতাদের আত্মগোপনে যাওয়ার বিষয়ে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দপ্তর সম্পাদক আনিসের ব্যাপারটা আমি শুনেছি, তবে বাস্তবতা জানি ন।”

অন্যদের বিষয়ে তিনি বলেন, “এই চলমান অভিযানে কে কোথায় আছে, তা বলা মুশকিল।”

যুবলীগের দাগিদের ধরতে ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা জানিয়েছিলেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী।

তার কী অবস্থা- জানতে চাইলে সাধারণ সম্পাদক বলেন, “আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান পর্যবেক্ষণ করছি।”

সম্রাট-শাওনের ব্যাংক হিসাব তলব

ঢাকা মহানগর যুবলীগের এখনকার নেতা সম্রাট ও সাবেক নেতা নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট -বিএফআইইউ।

একইসঙ্গে গ্রেপ্তার যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জিকে শামীমের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশও দিয়েছে বিএফআইইউ।

ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন

সোমবার সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো দুটি আলাদা চিঠিতে এ সব নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও বিএফআইইউ এর প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান।

সোমবার রাতে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাধারণত কোনো ঘটনার পর যাদের নাম জড়িয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এবং মিডিয়ায় খবর আসে, তাদের ব্যাংক লেনদেনের বিষয়ে আমরা খোঁজ-খবর নিয়ে থাকি।

“তারই ধারাবাহিকতায় এমপি শাওন সাহেব ও ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের ব্যাংকে কত টাকা আছে, টাকার উৎস কী,  এ সবই খতিয়ে দেখা হবে।”

যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাবেক নেতা শাওন এখন ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য।

খালেদ ভূঁইয়া ও জিকে শামীমের ব্যাংক হিসাব জব্দের বিষয়ে রাজী হাসান বলেন, “কোনো ব্যক্তিকে যে কোনো কারণে গ্রেপ্তার করা হলেই তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করার একটি বিধান আছে। সে মোতাবেক তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।”

যুবলীগের এই দুই নেতাকে গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ, মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করা হয়।