‘ক্যাসিনো’ চালানোর অভিযোগে যুবলীগ নেতা খালেদ ভূঁইয়া গ্রেপ্তার

ঢাকার ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে অবৈধভাবে ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

লিটন হায়দার অপরাধ বিষয়ক প্রধান প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Sept 2019, 01:49 PM
Updated : 19 Sept 2019, 00:09 AM

র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক সারোয়ার বিন কাশেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বুধবার সন্ধ্যায় গুলশানের বাসা থেকে খালেদকে তারা গ্রেপ্তার করেন।

ওই বাসা থেকে একটি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র এবং লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গের অভিযোগে দুটি অস্ত্র জব্দ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া

এদিন দুপুরের পর গুলশান ২ নম্বরের ৫৯ নম্বর সড়কে খালেদের বাসা এবং ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে একযোগে অভিযান শুরু করেন র‌্যাব সদস্যরা।

সন্ধ্যায় ওই ক্লাব থেকে ১৪২ জনকে আটক করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। ক্লাবে পাওয়া যায় মদ আর জুয়ার বিপুল আয়োজন। সেখান থেকে ২৪ লাখ টাকাও উদ্ধার করা হয় বলে সারোয়ার বিন কাশেম জানান।

শাহজাহানপুরের রেলওয়ে কলোনিতে বেড়ে ওঠা খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া ফকিরাপুলের ওই ক্লাবের সভাপতি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় যুবলীগ নেতাদের নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশের পর আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনটির প্রভাবশালী নেতা খালেদকে ধরতে অভিযান নামে র‌্যাব।

শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন প্রকল্পে চাঁদাদাবির অভিযোগে সমালোচনার মুখে থাকা রেজাওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী যুবলীগের কয়েকজন নেতাকে নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা ‘শোভন-রাব্বানীর চেয়েও খারাপ’ বলে মন্তব্য করেন।

“প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুবলীগের ঢাকা মহানগরের একজন নেতা যা ইচ্ছে করে বেড়াচ্ছে, চাঁদাবাজি করছে। আরেকজন এখন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে চলেন। সদলবলে অস্ত্র নিয়ে ঘোরেন। এসব বন্ধ করতে হবে। যারা অস্ত্রবাজি করেন, যারা ক্যাডার পোষেন, তারা সাবধান হয়ে যান, এসব বন্ধ করুন। তা না হলে, যেভাবে জঙ্গি দমন করা হয়েছে, একইভাবে তাদেরকেও দমন করা হবে।”

যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট এবং সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়াকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী ওই কথা বলেছিলেন বলে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়।

সম্রাটকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে র‌্যাব কর্মকর্তা সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, এ ধরনের কোনো খবর তাদের কাছে নেই।

অন্য দল থেকে এসেছেন খালেদ?

শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে বেড়ে ওঠা খালেদ ভূঁইয়ার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা খুব বেশি দিনের নয় বলে যুবলীগ নেতারা জানিয়েছেন।

২০০২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সোহেল শাহরিয়ার রানা (কানাডা প্রবাসী) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই খালেদ মাহমুদকে আমরা বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় চিনতাম যুবদলের ক্যাডার হিসেবে। কোনো পদপদবি না থাকলেও খালেদ সব সময় যুবদলের নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকত।

“আমি মতিঝিল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায়ই কানাডা চলে আসি। কিন্তু ২০১৩ সালে এই  যুবলীগের কমিটি দেওয়ার পর দেখি সন্ত্রাসী খালেদ যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছেন।”

গুলশানে খালেদের বাড়িতে অভিযান

এরপরে দেশে ফিরলে খালেদ নানাভাবে তার ও তার পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বলে অভিযোগ করেন শাহরিয়ার রানা।

তিনি বলেন, “খালেদের মাধ্যমে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের বঞ্চিত করে সন্ত্রাসী, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সহযোগী ও ফ্রিডম পার্টির ক্যাডার ও যুবদলের নেতাকে টাকার বিনিময়ে যুবলীগের পদ দেওয়া হয়েছে।”

স্থানীয় কয়েকজন ও যুবলীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতাও খালেদের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যুবলীগে সক্রিয় হওয়ার কথা জানান।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, মতিঝিল এলাকার এক সময়ের সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিতি ফ্রিডম পার্টির মানিক-মুরাদের সহযোগী ছিলেন খালেদ। এলাকায় আধিপত্য নিয়ে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠা মানিক-মুরাদ চারদলীয় জোট সরকার আমলে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসীদের’ তালিকায় চলে আসেন। এরপরেও গা ঢাকা দেন তারা।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মানিক-মুরাদের প্রভাবাধীন এলাকা নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। মতিঝিল, কমলাপুর, শাহজাহানপুর, বাসাবো, খিলগাঁওসহ আশপাশের এলাকায় প্রভাব তৈরি হয়েছিল তার।

খালেদকে গ্রেপ্তারের তার বাসার একজন প্রহরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্যার আজকে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাসায় আসেন, পরে দুপুর ২টার দিকে একদল র‌্যাব সদস্য এসে বাসায় ঢোকে এবং পুরো বাড়িরর আশপাশে অবস্থান নেয়।”

খালেদ ভূঁইয়া অন্য সময়ও সকালে বাসায় ফিরতেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “স্যার অনেক সময় রাত ২টা, ৩টা, ৪টা অথবা সকাল ৮টা-৯টার দিকে বাসায় ফেরেন। ওনার বাসায় আসা-যাওয়ার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।”

খালেদের ক্যাসিনো বন্ধ করার পর ঢাকার আরও তিনটি ক্লাবে অভিযান চালিয়ে জুয়ার ২৪ লাখ টাকা উদ্ধার এবং ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রে ক্যাসিনো

এই ক্লাবগুলো হল- ইয়ংমেনস ক্লাবের পাশের ঢাকা ওয়ান্ডারাস ক্লাব, গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র এবং বনানীর আহমদ টাওয়ারের গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ।

স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. কাওসার ওয়ান্ডারাস ক্লাবে ক্যাসিনো চালান বলে র্যর‌্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সেখান থেকে নগদ ২০ লাখ ২৭ হাজার টাকা, জুয়ার সরঞ্জাম, ২০ হাজার ৫০০ টাকার জাল নোট, বিপুল পরিমাণ মদ ও মাদক জব্দ করা হয়েছে।

পরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র থেকে জুয়ার সরঞ্জাম, চার লাখ ১৫ হাজার টাকা, একটি কষ্টি পাথরের মুর্তি উদ্ধার করা হয়। সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪০ জনকে। গ্রেপ্তারদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে বলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম জানিয়েছেন।
এছাড়া বনানীর আহমদ টাওয়ারে ‘গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ’ নামে একটি ক্যাসিনো চালানো হয়। সেখানে অভিযানে গিয়ে ক্যাসিনোটি তালাবন্ধ পাওয়া গেছে। সেটি সিলগালা করা হয়েছে, পরে ভেতরে তল্লাশি চালানো হবে।