শিশু আইনে বিশৃঙ্খলা, পর্যবেক্ষণ হাই কোর্টের

বিদ্যমান শিশু আইন নিয়ে বিচারিক আদালত ও উচ্চ আদালতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে বলে হাই কোর্টের এক রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 August 2019, 07:04 PM
Updated : 21 August 2019, 07:04 PM

পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, “দৈনন্দিন বিচারিক কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে এ কথা উচ্চারণে আমাদের দ্বিধা নেই যে, শিশু আইন ও আদালত নিয়ে বর্তমানে নিম্ন আদালত ও হাই কোর্ট বিভাগে এক ধরনের বিচারিক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।”

পুরান ঢাকার মো. ওসমান হত্যা মামলার আসামি শিশু মো. হৃদয়ের জামিন আবেদনের এক মামলায় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি জনাব মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ গত ১ আগস্ট এ রায় দেয়; যা বুধবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী। আসামি শিশু হৃদয়ের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন এম মশিউর রহমান। আদালত হৃদয়ের জামিন মঞ্জুর করে এ রায় দিয়েছে।

প্রকাশিত রায় ও আদেশের কপি প্রয়োজনীয় অবগতি ও ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট আদালত/ট্রাইব্যুনালসহ  সমাজকল্যাণ ও আইন  সচিব এবং সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পাশাপাশি শিশু আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অসঙ্গতিপূর্ণ, সাংঘর্ষিক ধারা যথাযথ সংশোধন ও স্পষ্ট না করা পর্যন্ত জটিলতা এড়াতে ৭ দফা নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।

রায়ে বলা হয়েছে, শিশু আইনে সাংঘর্ষিক অবস্থা, বিদ্যমান অসংগতি, অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি অবিলম্বে দূর করা প্রয়োজন। আদালত এটাও প্রত্যাশা করছে যে, এ লক্ষ্যে সরকার দ্রুততার সঙ্গে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সরকার শিশু আইন সংশোধন অথবা শিশু আইন ২০১৩-এর ধারা ৯৭-এর বিধান মূলে গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা অস্পষ্টতা ও অসংগতি দূর করতে পারে।

৭ দফা নির্দেশনা

>> সংশ্লিষ্ট ম্যাজিষ্ট্রেট কেবলমাত্র মামলার তদন্ত কার্যক্রম তদারক করবেন এবং এ সংক্রান্ত নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনীয় আদেশ ও নির্দেশনা দিবেন।

>> রিমান্ড সংক্রান্ত আদেশ শিশু আদালতেই নিষ্পত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে, আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু (ভিকটিম এবং সাক্ষী) বা আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর জবানবন্দি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট লিপিবদ্ধ করতে পারবেন।

>> তদন্ত চলাকালে আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুকে মামলার ধার্য তারিখে ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে।

>> তদন্ত চলাকালে আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর রিমান্ড, জামিন, বয়স নির্ধারণসহ অন্তর্বর্তী যে কোনো বিষয় শিশু আদালত নিষ্পত্তি করবে এবং এ সংক্রান্ত যে কোনো আবেদন ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে দাখিল হলে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট নথিসহ ওই দরখাস্ত সংশ্লিষ্ট শিশু আদালতে পাঠাবেন এবং সংশ্লিষ্ট শিশু আদালত ওই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করবে।

>> অপরাধ আমলে নেওয়ার আগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল শিশু আইনের অধীনে কোনো আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘শিশু আদালত’ হিসেবে আদেশ দেবে এবং এক্ষেত্রে বিচারক শিশু আদালতের বিচারক হিসেবে কাজ পরিচালনা করবেন এবং শিশু আদালতের নাম ও সিল ব্যবহার করবেন।

>> আইনের সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি হলো, আইন মন্দ বা কঠোর হলেও তা অনুসরণ করতে হবে; যতক্ষণ পর্যন্ত তা সংশোধন বা বাতিল না হয়। সে কারণে নালিশি মামলার ক্ষেত্রে শিশু কর্তৃক বিশেষ আইনসমূহের অধীনে সংঘটিত অপরাধ সংশ্লিষ্ট বিশেষ আদালত বা ক্ষেত্রমত, ট্রাইব্যুনাল শিশু আইনের বিধান ও এ রায়ের পর্যবেক্ষণের আলোকে অভিযোগ গ্রহণের পর প্রয়োজনীয় আইনি কার্যক্রম গ্রহণের পর অপরাধ আমলে নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্তের নথি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কছে পাঠাবে। ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধ আমলে নেওয়ার বিষয়ে প্রয়োজনীয় আদেশ প্রদান এবং অপরাধ আমলে নিলে পরবর্তীতে  কাগজাদি বিচারের জন্য শিশু আদালতে পাঠাবেন।

>> শিশু আইনের প্রাধান্যতার কারণে বিশেষ আইনসমূহের অধীনে জিআর মামলার ক্ষেত্রে শিশু কর্তৃক সংঘটিত অপরাধের জন্য পৃথক পুলিশ রিপোর্ট দেওয়ার বিধান থাকায় সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে অপরাধ আমলে নেবেন।

রায়ে বলা হয়, “আমাদের বলতে দ্বিধা নেই যে, শিশু আইনের ১৫ক নম্বর ধারা, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৭ নম্বর ধারা, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০-এর ২৭ নম্বর ধারা এবং ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৮ নম্বর ধারাসহ বিভিন্ন বিশেষ আইনের সঙ্গে শুধু অসংগতিপূর্ণই নয়, সাংঘর্ষিকও।”

ফাইল ছবি

রায়ে আরও বলা হয়েছে, শিশু আইনের প্রাধান্যতার কারণে যদি যুক্তি দেওয়া হয় যে, থানার দায়েরকৃত মামলা অর্থাৎ জিআর মামলার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধ আমলে গ্রহণ করবেন, তাহলে সেটা হবে শিশু আইন প্রনয়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থি।

“শুধু তাই নয়, একই আইনের অধীনে শিশুর বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে গ্রহণ করবেন ম্যাজিস্ট্রেট, আর প্রাপ্ত বয়স্কদের বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে গ্রহণ করবে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনাল বা ক্ষেত্রমত, আদালত, যা বাস্তবতা বিবর্জিত এবং অদ্ভুত বা অস্বাভাবিক একটি প্রস্তাবনা।”

আদালত রায়ে বলেছে, শিশু আইন-২০১৩ প্রনয়নের  মূল  লক্ষ্যই  ছিল শিশুদের (আসামি, ভিকটিম ও সাক্ষী) সর্বোত্তম স্বার্থ সংরক্ষণ করা। আদালতে শিশুবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা।

“কিন্তু এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, দেশের শিশু আদালতগুলোতে এখন পর্যন্ত শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা  সম্ভব হয়নি। সেক্ষেত্রে শিশু আদালতের বাইরে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা নিঃসন্দেহে একটা বড় চ্যালেঞ্জ।”

রায়ে বলা হয়েছে, “এটা বাস্তবতা যে, শিশু আইন-২০১৩-এর ১৬ক, ১৫ক এবং ১৬(৩) ধারা সংযোজিত হওয়ায় বিভিন্ন ধরনের সংশয়, বিভ্রান্তি এবং সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণে শিশুদের সর্বোচ্চ স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য এসব সংশয়, বিভ্রান্তি ও অসংগতি দূর করা জরুরি।

“শিশু আইনের অধীনে কোনো আদেশের ক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের নাম, সিল ও পদবী ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। আমরা লক্ষ্য করছি যে, বিচারের আগে বিভিন্ন আদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের নাম, সিল ব্যবহার  করা হচ্ছে। এতে সংক্ষুব্ধ পক্ষের উচ্চতর আদালতে আসার ক্ষেত্রে এখতিয়ার নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে।”