রিফাত হত্যার তদন্তে ‘হস্তক্ষেপ করবে না’ হাই কোর্ট

দেশজুড়ে আলোচিত বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলার তদন্তে হাই কোর্ট কোনো হস্তক্ষেপ করবে না বলে জানিয়েছে একটি বেঞ্চ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 July 2019, 09:14 AM
Updated : 18 July 2019, 09:18 AM

রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেপ্তার, রিমান্ড, জিজ্ঞাসাবাদে নেওয়ার বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদ আদলতের নজরে আনা হলে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এ কথা জানায়।

এ বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদ আদালতে উপস্থাপন করে আইনজীবী ফারুক হোসেন এদিন বলেন, বাদীর সবচেয়ে আস্থাভাজন হিসেবে মিন্নিকে এক নম্বর সাক্ষী করা হয়েছে। অথচ তাকে ১২ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে আদালতে তোলা হয়।

“আদালত ৫ দিনের রিমাণ্ড দিয়েছেন। এ বিষয়টি উচ্চ আদালতের দেখা উচিত। তার পক্ষে কোনো আইনজীবীও দাঁড়াচ্ছে না।”

বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক তখন বলেন, “পুলিশ তদন্ত করছে। এটাতে আমরা ইন্টারফেয়ার করতে পারি না।”

আইনজীবী তখন বলেন, “তদন্ত হবে। কিন্তু সে (মিন্নি) তো সাক্ষী। তাকে রিমাণ্ডে নেওয়া হয়েছে।”

বিচারক তখন বলেন, “সে তো এখন গ্রেপ্তার। পুলিশ বলছে তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। এখন আপনার কিছু করার থাকলে ফৌজদারি নিয়ম মেনে করুন। প্রপার চ্যানেলে আসুন। আমরা তদন্তে ইন্টারফেয়ার করতে পারি না।”  

পরে আইনজীবী ফারুক হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আদালতের কাছে বলেছি, এ মামলার চার্জশিটভুক্ত পাঁচ আসামিকে এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি। সেখানে মামলার এক নম্বর সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তাকে রিমাণ্ডে নেওয়ার কারণে মামলাটি অন্যদিকে চলে যেতে পারে। এ কারণে আমি বিষয়টি আদালতের নজরে এনেছিলাম।”

গত ২৬ জুন রিফাতকে প্রকাশ্য সড়কে কুপিয়ে হত্যার সময় স্বামীকে বাঁচাতে মিন্নির চেষ্টার ভিডিও ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ঘটনাটি সারাদেশে আলোচনায় উঠে আসে।

পরদিন শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফের বাবা দুলাল শরীফ ১২ জনকে আসামি করে যে মামলাটি করেন, তাতে প্রধান সাক্ষী করা হয়েছিল মিন্নিকেই।

কিন্তু তিন দিন আগে পুত্রবধূর বিরুদ্ধে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ তোলার পর আলোচনা নতুন দিকে মোড় নেয়।

ফাইল ছবি

দুলাল শরীফের অভিযোগ, হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি সাব্বির আহমেদ নয়নের (নয়ন বন্ড) সঙ্গে বিয়ে গোপন করেই তার ছেলে রিফাত শরীফকে বিয়ে করেন মিন্নি। বিয়ের পরও নয়নের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।

এরপর মঙ্গলবার সকালে মিন্নিকে বরগুনার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া হয় জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে। দিনভর জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর কথা জানান পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন।

তিনি সেদিন বলেন, “তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ও সুদীর্ঘ সময় যাবৎ প্রাপ্ত তথ্যাদি পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণপূর্বক হত্যাকাণ্ডের সাথে তার সংশ্লিষ্টতা প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হওয়ায় মামলার মূল রহস্য উদ্ঘাটন এবং সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে মিন্নিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”

বুধবার মিন্নিকে আদালতে হাজির করে পুলিশের পক্ষ থেকে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হলে শুনানি শেষে বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের বিচারক মো. সিরাজুল ইসলাম গাজী পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

শ্বশুর অভিযোগ তোলার পর মিন্নি তা অস্বীকার করে বলেছিলেন, দুলাল শরীফ ‘ষড়যন্ত্রকারীদের প্ররোচনায়’ পড়ে তাকে জড়িয়ে ‘বানোয়াট’ কথা বলছেন।

এই হত্যাকাণ্ডে মূল আসামি নয়নের সন্ত্রাসী দল ‘বন্ড ০০৭ অত্যন্ত শক্তিশালী’ দাবি করে তিনি বলেছিলেন, “তারা নিজেদের বাঁচাতে হত্যাকাণ্ডের মোড় ঘোরানোর চেষ্টা করছে।”

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নয়নের সঙ্গে নিজের ছবিকে ‘অপপ্রচার’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন মিন্নি।

শ্বশুরের অভিযোগ নাকচ করে তিনি বলেছিলেন, নয়ন তাকে উত্ত্যক্ত করতেন, তার সঙ্গে নয়নের বিয়ে হয়নি। জোর করে কাবিনে সই নেওয়া হয়েছিল।

দুলাল শরীফ সংবাদ সম্মেলন করার পরদিন মিন্নিকে গ্রেপ্তারের দাবিতে বরগুনা প্রেস ক্লাবের সামনে ‘সর্বস্তরের জনগণ’ ব্যানারে মানববন্ধন হয়। স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক সুনাম দেবনাথও ছিলেন সেখানে।

এই হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি যে সাব্বির আহমেদ নয়ন (নয়ন বন্ড) পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে পরে নিহত হন, তাকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ ছিল এমপিপুত্র সুনামের বিরুদ্ধে; যদিও সুনাম তা অস্বীকার করে আসছেন।

এই হত্যাকাণ্ডের অন্য দুই প্রধান আসামি দুই ভাই রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে। তবে দেলোয়ারও তার স্বজনদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার অভিযোগ নাকচ করেছেন।

আসামি রিফাত ফরাজীকে গ্রেপ্তার করা হলেও রিশান পলাতক ছিল। বৃহস্পতিবার জেলার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, রিশানকে সকাল ১০টার দিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে কোথা থেকে তাকে ধরা হয়েছে, সে তথ্য তিনি দেননি।

রিফাত শরীফের স্ত্রী মিন্নিকে পুলিশ যেভাবে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে, তা নিয়ে বুধবার রাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতেও আলোচনা হয়। এর পেছনে প্রভাবশালী কারও প্ররোচনা রয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন তোলেন একজন সংসদ সদস্য।

এদিকে মিন্নিকে বুধবার আদালতে হাজির করার পর তার পক্ষে কোনো আইনজীবীর না দাঁড়ানো নিয়েও আলোচনা চলছে।

মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন, তিনি তিন জন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তাদের দাঁড়ানোর কথাও ছিল, কিন্তু তারা শুনানিতে অংশ নেননি।

ওই তিন আইনজীবী শুনানিতে না দাঁড়ানোর কারণ হিসেবে ওকালতনামায় সই না হওয়ার কথা বললেও মিন্নির বাবার সন্দেহ, ‘প্রতিপক্ষের ভয়েই’ আইনজীবীরা তার মেয়ের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন না।

বরগুনার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে বুধবার রিমান্ড শুনানির সময় মিন্নির পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় তাকেই কথা বলার সুযোগ দেন বিচারক।

মিন্নি আদালতে বলেন, “আমার স্বামী রিফাত শরীফ। আমি আমার স্বামীর হত্যাকারীদের বিচার চাই। হত্যাকাণ্ডে আমি জড়িত নই। এ মামলায় আমাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে।”