এই কমিশনে অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও দক্ষ ব্যক্তিদের রাখতে বলা হয়েছে। কমিশনের দায়িত্ব হবে কর্মরত সরকারি চিকিৎসকদের দায়িত্ব বণ্টন, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, কর্মঘণ্টার বাইরে কর্মস্থলে দায়িত্ব পালনসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করা।
শুনানিতে আদালত বলেছে, সেবাধর্মী পেশা হিসেবে চিকিৎসা নিয়ে বাণিজ্য যেন মুখ্য না হয়ে ওঠে, সে জন্য একটি নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।
সরকারি চিকিৎসকদের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে গত ৪ ফেব্রুয়ারি আবেদনটি করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ান, সালাহ উদ্দিন রিগ্যান, সুজাদ মিয়া, আমিনুল হক ও কাউছার উদ্দিন মন্ডল।
রিট আবেদনেও চিকিৎসকদের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করতে বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল।
তার উপর শুনানি নিয়ে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার রুলের পাশাপাশি কমিশন গঠনের আদেশ দেয়।
‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস এন্ড প্রাইভেট ক্লিনিক এন্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’র ৪ ধারা কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, অসাংবিধানিক, বেআইনি ও বাতিল ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।
দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস এন্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস এন্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেসন্স) অর্ডিন্যান্স-১৯৮২ এর ৪ ধারায় সরকারি চাকরিজীবী চিকিৎসকদের কর্মসময়ের বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ রাখা হয়েছে।
স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতিকে রুলের জবাব দিতে হবে। আদালতের আদেশও বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে তাদের।
আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন সাত্তার পালোয়ান নিজেই। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
শুনানিতে বিচারক বলেন, সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে। সরকার কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে চিকিৎসা খাতে। কিন্তু সাধারণ মানুষ অসুস্থ হয়ে আসলে সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না, ওষুধ পাচ্ছেন না প্যারাসিটামল ছাড়া। হাসপাতালের ওষুধ বাজারে পাওয়া যায়।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিযানে ১১টি সরকারি হাসপাতালে অভিযানে ঢাকায় ৪০ এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ৬২ শতাংশ চিকিৎসককে কর্মস্থলে না পাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে বিচারক বলেন, এতেই বোঝা যায় দেশের স্বাস্থ্যখাতে কী অবস্থা! সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে যাতে কেউ ব্যবসা করতে না পারে, সেজন্য একটি নীতিমালা থাকা উচিৎ।
তিনি লক্ষ্মীপুর সরকারি হাসপাতালের একটি ঘটনা তুলে ধরে বলেন, সেখানে চিকিৎসক নিজের ক্লিনিকে থাকায় একজন রোগী চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছে।
সাত্তার পালোয়ান আইনের ৪ নম্বর ধারাটি বাতিলের আরজি জানান।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আল মাহমুদ বাশার শুনানিতে বলেন, জনগণের স্বাস্থ্য সেবা যাতে নিশ্চিত হয়, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাসপাতালে চিকিৎসকদের উপস্থিতির উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
এ পর্যায়ে বিচারক বলেন, “চিকিৎসকরা তো মানুষ। এখন কোনো সার্জন যদি রাত ২টা পর্যন্ত প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসা দেন, তাহলে ওই চিকিৎসক কীভাবে সরকারি হাসপাতালে গিয়ে সকালে চিকিৎসা দেবেন? তাকে তো শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট থাকতে হবে।
“১৯৮২ সালের মতো পরিস্থিতি তো দেশে এখন আর নেই। প্রতিবছরই প্রচুর সংখ্যক চিকিৎসক বের হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হল সবাই ঢাকার হাসপাতালে থাকতে চায়।”
আদেশের পর সাত্তার পালোয়ান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস এন্ড প্রাইভেট ক্লিনিক এন্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স' ১৯৮২ এর ৪ ধারায় বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মরত কোনো রেজিস্টার্ড চিকিৎসক অফিস চলাকালীন সময়ে প্রাইভেট মেডিকেলে প্র্যাকটিস করতে পারবেন না।
“দেখে মনে হতে পারে, এটি একটি ভালো নিয়ম। কিন্তু এ ধারার মাধ্যমে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকদের মূলত প্রাইভেট প্র্যাকটিস করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। তাই এ ধারা নিয়ে আদালত রুল জারি করেছেন।
“এছাড়া কর্মরত সরকারি চিকিৎসকদের প্র্যাকটিসের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন তৈরিতে স্বাধীন কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন।”
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আল মাহমুদ বাশার বলেন, “চিকিৎসা পেশা নিয়ে অনেকগুলো আইন রয়েছে। ওইসব আইন পর্যালোচনা করে একটি সমন্বিত প্র্যাকটিসিং নীতিমালা প্রণয়ন করতে বলেছে হাই কোর্ট।”
রিট আবেদনটি করার আগে গত ২৯ জানুয়ারি বিবাদীদের কাছে একটি উকিল নোটিস পাঠিয়েছিলেন আইনজীবী সাত্তার পালোয়ান।
ওই নোটিশে বলা হয়েছিল, “সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী চিকিৎসা পাওয়া প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সম্প্রতি নিজ কর্মস্থল সরকারি হাসপাতাল রেখে অনেক ডাক্তার তার ব্যক্তিগত চেম্বারে চিকিৎসা দিচ্ছেন। ফলে রোগীরা সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকার নির্ধারিত কর্মঘণ্টা চলাকালে সরকারি ডাক্তারদের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্র্যাকটিস করা শুধুই পেশাগত অসদাচরণই নয়, আইনের দৃষ্টিতে এটা অপরাধ।”