রোহিঙ্গারা শিগগিরই ফিরছে না: জাতিসংঘ দূত

মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি বলেছেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর আশু কোনো সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Jan 2019, 05:56 PM
Updated : 25 Jan 2019, 07:34 PM

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সরকারকে ‘তাড়াহুড়ো’ না করারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

সাত দিনের বাংলাদেশ সফরে আশ্রয় শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি এবং নোয়াখালীর ভাসান চরের অবস্থা নিজের চোখে দেখে ফিরে যাওয়ার আগে শুক্রবার ঢাকায় এক ব্রিফিংয়ে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন ইয়াংহি লি।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গারা যে শিগগিরই মিয়ানমারে ফিরতে পারছে না, এটা এখন স্পষ্ট।”

মিয়ানমারের রাখাইনে নিপীড়নের শিকার বাংলাদেশে আসা এই জনগোষ্ঠীর এ দেশে অবস্থানের প্রশ্নে দীর্ঘমেয়দী একটি পরিকল্পনা করতে সরকারকে পরামর্শ দেন তিনি। 

২০১৭ সালের অগাস্টে রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযান শুরুর পর থেকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা।

তাদের কক্সবাজারের কয়েকটি কেন্দ্রে আশ্রয় দিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় জরুরি মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকার।

আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চুক্তি করার পর ২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রত্যাবাসন শুরুর প্রস্তুতি নিয়েছিল বাংলাদেশ।

কিন্তু মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে রোহিঙ্গাদের মনে আস্থা না ফেরায় এবং তারা কেউ ফিরে যেতে রাজি না হওয়ায় সেই পরিকল্পনা অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে যায়।

জাতিসংঘ দূত বলেন, “রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান মিয়ানমারেই নিহিত। কিন্তু তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির বদলে মিয়ানমার সহিংসতা আর নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।”

নির্বাচনের ব্যস্ততা যেহেতু পার হয়ে গেছে, সেহেতু এখন রোহিঙ্গাদের বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদী একটি পরিকল্পনা তৈরি করার এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সেজন্য প্রস্তুত করার পরামর্শ দেন ইয়াংহি লি।

তিনি বলেন, “তা না করতে পারলে শরণার্থীদের ওপর যেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তেমনি বাংলাদেশিদের মধ্যেও বিরূপ প্রভাব পড়বে, যারা ইতোমধ্যে শরণার্থীদের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন।”

ভাসান চরে ‘তাড়াহুড়ো নয়’

রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি দেখতে মিয়ানমারে যাওয়ার কথা ছিল জাতিসংঘের স্বাধীন দূত ইয়াংহি লির। কিন্তু পক্ষপাতের অভিযোগ এনে মিয়ানমার তাকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি।

এই পরিস্থিতিতে গত শনিবার বাংলাদেশে আসেন বিশেষ দূত। এরপর গত কয়েক দিন তিনি কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখেন।

বৃহস্পতিবার তিনি যান নোয়াখালীর ভাসানচরে, যেখানে এক লাখ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। ২৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ চলছে।  

হেলিকপ্টারে চড়ে ভাসানচর ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে ইয়াংহি লি বলেন, বাংলাদেশ সরকার যে ওই চরের উন্নয়নে বিপুল শ্রম ও সম্পদ কাজে লাগাচ্ছে, এ নিয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই।

তবে তিনি নিজে যেহেতু কারিগরি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন, ওই চরের বাসযোগ্যতা বা ভৌত অবকাঠামো নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি জাতিসংঘের দূত। 

তার বদলে তিনি ভাসান চরের কারিগরি ও নিরাপত্তার দিকগুলো জাতিসংঘের মাধ্যমে খতিয়ে দেখার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

ইয়াংহি লি বলেন, “আমাকে বলা হয়েছে, বর্ষা মৌসুমের আগেই কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ভাসান চরে সরিয়ে নেওয়া হবে। তবে এ বিষয়ে তাড়াহুড়া করা মোটেও উচিৎ হবে না।”

শরণার্থীদের মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের এই বিশেষজ্ঞ বলেন, স্থানান্তরের কথা ভাবার আগে অবশ্যই একটি নীতিকাঠামো ঠিক করতে হবে এবং রোহিঙ্গাদের সম্মতি নিতে হবে। তাদের প্রতিনিধিদের ভাসান চর ঘুরিয়ে দেখাতে হবে, যাতে তারা যাওয়া-না যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

“রোহিঙ্গারা সব জেনে বুঝে সম্মতি দেওয়ার আগে তাদের স্থানান্তরের পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়া ঠিক হবে না।”  

ইয়াংহি লি বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা ভাসান চরে যেতে রাজি হবেন, তারা কক্সবাজারের শরণার্থীদের মতই সব মৌলিক সুযোগ সুবিধা পাবেন বলে বাংলাদেশ সরকার তাকে আশ্বস্ত করেছে।  

সরকার বলেছে, নোয়াখালীর ওই চরে রোহিঙ্গাদের জন্য স্বাস্থ্য সেবা ও প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে, তারা যাতে চাষাবাদ বা মাছ ধরার মত কাজ করতে পারেন, সে ব্যবস্থাও করা হবে।

দ্বীপে তাদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দেওয়া হবে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তারা কক্সবাজারে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। তবে বাংলাদেশের অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ তাদের থাকবে না।

কিন্তু ভাসান চরে গেলে রোহিঙ্গাদের যে বিচ্ছিন্ন জীবন কাটাতে হবে, বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড়ের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তারা কতটা নিরাপদে থাকতে পারবেন- তা নিয়ে নিজের সংশয়ের কথা বলেন ইয়াংহি লি।

তিনি বলেন, এই স্থানান্তর যেন নতুন কোনো সঙ্কটের জন্ম না দেয়, তা সবার আগে ভাবতে হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে ‘ধৈর্য্যশীল ও সতর্ক’ হওয়ার এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করার পরামর্শ দেন বিশেষ দূত।   

তিনি বলেন, তাড়াহুড়ো করে রোহিঙ্গাদের ওই চরে পাঠানো হলে তা মিয়ানমারকেও ভুল বার্তা দেবে। মিয়ানমার ভাবতে পারে যে, বাংলাদেশ যেহেতু রোহিঙ্গাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা নিচ্ছে, তাদের আর ফেরত না নিলেও চলবে।

মিয়ানমার পরিস্থিতি

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরার মত অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি জানিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এখনই প্রত্যাবাসন শুরুর বিরোধিতা করে আসছিল।

তাদের যুক্তি ছিল, রাখাইনে নিপীড়ন এখনও থামেনি। এখনও সেখান থেকে হত্যা, গুম আর গণগ্রেপ্তারের খবর আসছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব আর মৌলিক অধিকারের ফয়সালা এখনও হয়নি।

বাংলাদেশ সফর শেষে বিদায় নেওয়ার আগে মিয়ানমারে মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লিও একই কথা বলে গেলেন।

তিনি বলেন, মিয়ানমার সরকার ও দেশটির সেনাবাহিনী দেশে শান্তি ফেরানোর জন্য কাজ করে যাওয়ার কথা বলে এলেও সেখানে ধর্ম আর গোত্রের ভিত্তিতে বিভক্তি এখনও প্রকট। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো এখও নিপীড়িত, অধিকার থেকে বঞ্চিত। গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা এখনও বহু দূর। 

মিয়ানমারের কাচিন, শান ও রাখাইন রাজ্য থেকে এখনও সংঘাত-সহিংসতার খবর আসায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন জাতিসংঘের দূত। 

তিনি বলেন, কায়ান রাজ্য থেকেও সংঘাতের খবর আসছে। কাইয়াহ রাজ্যে নতুন ঘাঁটি বানাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।  

আশ্রয় শিবিরের অভিজ্ঞতা

ইয়াংহি লি বলেন, কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয় শিবির ঘুরে, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে তার কাছে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, তাদের ফেরার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির কোনো চেষ্টাই মিয়ানমার করছে না। বরং এখনও তারা সহিংসতা, নিপীড়ন আর হয়রানি করে যাচ্ছে।   

“একজনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, যে কিছুদিন আগে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছে। তার মা আর বোনদের তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিল। তারপরই সে বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নেয়।

“আমি এ বছরের কিছু ভিডিও দেখেছি, সেখানে মংডুতে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি পুড়ছিল। আমার লোকজন যে তথ্য পেয়েছে তাতে রাখাইনের উগ্রপন্থিদের নিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীই ওই কাজ করেছে।”     

ইয়াংহি লি বলেন, যারা এখনও রাখাইনে রয়ে গেছে, তাদের ওপর এখনও নির্যাতন চালানো হচ্ছে, যাতে তারা বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়।