জুলহাজ-তনয় হত্যায় গ্রেপ্তার আসাদুল্লাহ রিমান্ডে

রাজধানীর কলাবাগানে সমকামী অধিকার কর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ‘আনসার উল্লাহ বাংলাটিমের এক জঙ্গিকে’ গ্রেপ্তার করেছে কাউন্টার টেররিজম পুলিশ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Jan 2019, 12:34 PM
Updated : 12 May 2019, 11:52 AM

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. ওবায়দুর রহমান জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টা গাজীপুরের টঙ্গী এলাকা থেকে আসাদুল্লাহ নামের ২৫ বছর বয়সী ওই যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদস্যরা।

বুধবার আসাদুল্লাহকে ঢাকার হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশের পক্ষ থেকে দশ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করা হলে মহানগর হাকিম মামুনুর রশিদ তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

পুলিশ বলছে, গ্রেপ্তার আসাদুল্লাহ (২৫) নিষিদ্ধ জঙ্গি দল আনসার উল্লাহ বাংলাটিমের সামরিক শাখার ‘একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য’। বিভিন্ন সময়ে ফখরুল, ফয়সাল, জাকির বা সাদিক নাম নিয়ে তিনি সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন। ২০১৬ সালে উত্তর বাড্ডার সাঁতারকুলে পুলিশের ওপর হামলা করে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাতেও জড়িত ছিলেন তিনি।

আসাদুল্লাহসহ পাঁচজন ঢাকার কলাবাগানে জুলহাজ-তনয় হত্যায় সরাসরি অংশ নেয় বলে বুধবার পুলিশের এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।  

দেশজুড়ে ‘উগ্রপন্থিদের’ একের পর এক হত্যা-হামলার মধ্যে ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের লেক সার্কাস রোডের এক বাসায় ঢুকে ইউএসএইড কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু থিয়েটারকর্মী মাহবুব তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

জুলহাজ-তনয়কে হত্যার পর খুনিরা পালানোর সময় ওই বাড়ির দারোয়ান পারভেজ মোল্লাও তাদের হামলার শিকার হন।

ওই সময় একজনের কাছ থেকে একটি ব্যাগ ছিনিয়ে রাখেন কলাবাগান এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এএসআই মমতাজ; সেখানে একটি পিস্তল, একটি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও মোবাইল ফোন পাওয়া যায়।

ঘটনার রাতেই জুলহাজের ভাই মিনহাজ মান্নানের পক্ষ থেকে অজ্ঞাতপরিচয় পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করে কলাবাগান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।

এএসআই মমতাজের ওপর হামলা এবং অস্ত্র পাওয়ার ঘটনায় অপর মামলাটি করেন কলাবাগান থানার এসআই শমীম আহমেদ।

এ মামলার তদন্তে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য বুধবার ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তুলে ধরেন কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম ।

তিনি বলেন, জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল ১৩ জন।

“ঘটনাস্থলে ছিল ৭ জন। তাদের মধ্যে ৫ জন ভেতরে যায়। অর্থাৎ কিলিং মিশনে পাঁচজন ছিল। আসাদুল্লাহ ওই পাঁচজনের একজন।”

মনিরুল ইসলাম জানান, ওই ঘটনায় জড়িত মোট চারজনকে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

আসাদুল্লাহ ছাড়া বাকি তিনজন হলেন আরাফাত ওরফে শামস ওরফে সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ, সায়মন ওরফে শাহরিয়ার এবং আবদুল্লাহ ওরফে জুবায়ের ওরফে জায়েদ ওরফে জাবেদ ওরফে আবু ওমায়ের।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আসাদুল্লাহর বাড়ি ঝিনাইদহের মহেশপুরের মদনপুরে। তার বাবার নাম এমদাদুল হক। গত কিছুদিন ধরে টঙ্গীর মরকুন কবরস্থান গেইট এলাকায় থাকছিলেন আসাদুল্লাহ।

তার পরিবার জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত জানিয়ে মনিরুল বলেন, “আসাদুল্লাহ আনসার উল্লাহ বাংলা টিমে যোগ দেওয়ার আগে নোয়াপাড়া ইউনিয়নে শিবিরের সাথী ছিল। সে মদনপুর দাখিল মাদ্রাসা এবং যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে লেখাপড়া করেছে।

“আর তার বাবা চুয়াডাঙ্গার মাধবপুর ইসলামিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। তিনি সে সময় ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর রুকন।”

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, লেখক অভিজিৎ রায় হত্যার প্রধান সন্দেহভাজন শরীফুল ওরফে মুকুল রানার মাধ্যমে ২০১৫ সালের শেষ দিকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে যোগ দেন আসাদুল্লাহ, তখন তার নাম হয় ফয়সাল। ঢাকার উত্তর বাড্ডার একটি বাসায় ২০১৬ সালের শুরুতে তাকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

পরের বছর জুনে ঢাকার খিলগাঁওয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন মুকুল রানা। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, রানা এবং অভিজিৎ হত্যার সন্দেহভাজন শরীফুল একই ব্যক্তি।

বুধবার পুলিশের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০১৬ সালের এপ্রিলে কলাবাগানের বাসায় গিয়ে জুলহাজ ও তনয়কে হত্যার পরিকল্পনা করার পর তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে আনসারুল্লাহর জঙ্গিরা। পরিকল্পনা অনুযায়ী কুরিয়ার সার্ভিসের ভুয়া আইডি ও পার্সেল নিয়ে তারা ওই বাসায় যান।

ঘটনার দিন টঙ্গী থেকে বাসে করে ঢাকায় আসেন আসাদুল্লাহ। সাতজনের ওই দলের মধ্যে পাঁচজন জুলহাজদের বাড়িতে ঢোকেন। ভুয়া পার্সেল হাতে ছয়তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় জুলহাজদের ফ্ল্যাটে যান তাদের মধ্যে তিনজন।

বাকি দুজন বাড়ির ফটকে থাকা দারোয়ান পারভেজ মোল্লাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করে এবং তাকে আটকে রাখে। ওই দুইজনের দলে ছিলেন আসাদুল্লাহ।

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক দীপু মনির খালাত ভাই জুলহাজ (৩৫) সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার প্রটোকল কর্মকর্তা ছিলেন। পরে তিনি যোগ দেন উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএইডে। ‘রূপবান’ নামে একটি সাময়িকীর সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন তিনি।

জুলহাজের বন্ধু নিহত মাহবুব রাব্বী তনয় (২৬) নাট্য সংগঠন লোকনাট্য দলের কর্মী ছিলেন। শিশু সংগঠন ‘পিপলস থিয়েটার’ এ ‘শিশু নাট্য প্রশিক্ষক’ হিসেবেও কাজ করতেন তিনি।

ওই হত্যায় জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করার কথা বললেও গত প্রায় তিন বছরে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেনননি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। আগামী ২২ জানুয়ারি আদালতে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার দিন ধার্য রয়েছে।

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, খুব শিগগিরই তারা এ মামলার অভিযোগপত্র দিতে চান।