ঘরে নির্যাতিত ৭২ শতাংশ নারীই ঘটনা চেপে যান: গবেষণা

বাংলাদেশে নারীদের প্রতি তিনজনে দুইজন নিজের ঘরে নির্যাতনের শিকার এবং অধিকাংশই ঘটনাগুলো চেপে যান বলে একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Dec 2018, 04:07 PM
Updated : 6 Dec 2018, 04:07 PM

বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের যৌথ আয়োজনে ‘সহিংসতা ও প্রতিরোধ’ শীর্ষক সেমিনারে ওই গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা এবং এর সমাধান খুঁজতে ‘বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার উপর দৃষ্টিপাত: প্রবণতা এবং সমাধান’ নামে গবেষণাটি করে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ এবং জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ফোরাম-জেএনএনপিএফ।

সেমিনারে গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে গবেষক আহমেদ ইব্রাহিম বলেন, “নিজ সঙ্গী দ্বারা সহিংসতার শিকার হওয়ার হার উচ্চ হওয়া স্বত্ত্বেও বাংলাদেশের বেশিরভাগ নারী (৭২ দশমিক ৭ শতাংশ) তাদের অভিজ্ঞতার কথা কাউকে বলেন না।

“মাত্র ২.১ শতাংশ নারী স্থানীয় নেতাদের কাছে অভিযোগ করেন এবং মাত্র ১.১ শতাংশ নারী পুলিশের কাছে সাহায্য চান।”

বাংলাদেশে নারীরা এখনও নিজের ঘরে নির্যাতন, অত্যাচার ও সহিংসতার শিকার হলেও গণমাধ্যমে পারিবারিক সহিংসতার বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায় বলে মনে করেন এই গবেষক।

তিনি বলেন, “শুধু ১০.৭ শতাংশ মামলা থাকে পারিবারিক বিরোধ সংক্রান্ত …। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ৭৫ শতাংশ প্রতিবেদনই ধর্ষণ বা গণধর্ষণ সম্পর্কিত। ফলে নারীরা ঘরেই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ এমন ধারণাকেই প্রচার করা হয়।”

প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার বেজলাইন জরিপ ২০১৫’র তথ্য এবং দেশের ২০ জেলায় সহিংসতার চিত্র অনুযায়ী নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ব্যাপক রূপ হচ্ছে ‘পারিবারিক সহিংসতা’।

এ প্রসঙ্গে আহমেদ ইব্রাহিম বলেন, “নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার মামলার প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে দুইজন অর্থাৎ ৬৬ শতাংশ নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কিত মামলাগুলোর প্রতি পাঁচটির মধ্যে চারটি মামলাই আদালতে উত্থাপিত হতে দুই বছর পর্যন্ত লেগে যায়। তারপর শুরু হয় বিচারিক প্রক্রিয়া।

“সহিংসতায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৩.১ শতাংশ নিজেদের পক্ষে বিচার পায়, বাকি ৯৬.৯ শতাংশ ভুক্তভোগীর অভিযোগ আদালতে শুনানির পর্যায়ে যায় না বা গেলেও বাতিল হয়ে যায়।”

‘নগরাঞ্চলে সহিংসতা: ভালো কি মন্দ?’ শিরোনামে প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “জানুয়ারি ২০১৭ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৮ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ঢাকায়, যার সংখ্যা ২৮৩৯।

“ঢাকায় লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১৭৬টি, কিন্তু অধিকাংশ সহিংসতার ঘটনার কথা বলা হয় না।”

সহিংসতার এই হার কমিয়ে আনার জন্য নতুন পদ্ধতির কথা ভাবতে হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ।  

“দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টির পদ্ধতিকে প্রয়োজনে নতুনভাবে সাজাতে হবে।” 

সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির। 

তিনি বলেন, “সহিংসতা কোনো আন্তর্জাতিকভাবে উদযাপনের বিষয় নয়। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ একটি অস্তিত্বের যুদ্ধ। এখনই সময় সমাজের সকল স্তরের মানুষ মিলে সহিংসতার বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করার এবং প্রতিরোধের উপায় খুঁজে বের করার।”

নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা রোধে ‘আরবান রেজিলিয়েন্স’ বিষয়ক প্রবন্ধে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস বিভাগের ব্যবস্থাপক এ এম নাসির উদ্দিন বলেন, “সহিংসতা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে দেশের বিদ্যমান আইনের সঠিক বাস্তবায়নের অভাব সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। অপরদিকে শহরের অবকাঠামোগত পরিকল্পনায় নেই নারীবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গি, আইনি কাঠামোতে নেই হয়রানির কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা।”

তিনি বলেন, “বর্তমান সময়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে যতটা মনোযোগ দেওয়া হয় সহিংসতা প্রতিরোধের বিষয়ে সেভাবে মনোযোগ দেওয়া হয় না। শহরাঞ্চলে প্রত্যেক নাগরিকের, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিতে প্রয়োজন গণসেবার সহজলভ্যতা ও অভিগম্যতা।”

সেমিনারে অন্যদের মধ্যে জেন্ডার বিশেষজ্ঞ এবং সাংগাতের প্রতিনিধি ফৌজিয়া খন্দকার ইভা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সহকারী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন এবং কালারস এফএমের প্রধান (অপারেশন) তাসনুভা আহমেদ আলোচনা করেন।