বিএনপি প্রার্থী আরিফুল এগিয়ে থাকলেও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুটি কেন্দ্রে ভোট স্থগিতের কারণে আটকে গেছে ফল।
সোমবার অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনের ভোটার এবং ভোটের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওই দুটি কেন্দ্রের সব ভোটার ভোট দিলে এবং তার প্রায় সব ভোট কামরানের বাক্সে পড়লে তবেই আরিফুল হারতে পারেন।
এই ধরনের ঘটনা ঘটলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পিছিয়ে থাকা প্রার্থীর নিজের পরাজয় স্বীকার করে নেওয়ার নজির ভুরি ভুরি থাকলেও সিলেটে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী কামরানের পক্ষে পুনর্গণনার দাবি তোলা হয়েছে।
অন্যদিকে বিকালে ভোটগ্রহণের পরপরই আরিফুল ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলে ফল প্রত্যাখ্যানের আগাম ঘোষণা দিয়েছিলেন।
কিন্তু রাতে ঘোষিত কেন্দ্রের ফল দেখে উল্লসিত সমর্থকদের মধ্যে থাকা এই বিএনপি নেতা বলেন, তিনি ভোটের অনিয়মের ঘটনায় ‘ঘৃণা’ প্রকাশ করতে ফল প্রত্যাখ্যানের ওই কথা বলেছিলেন।
সিলেট সিটি করপোরেশনে ১৩৪টি কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ২১ হাজার ৭৩২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৭১ হাজার ৪৪৪ জন এবং নারী ১ লাখ ৫০ হাজার ২৮৮ জন।
রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলীমুজ্জামান ১৩২টি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করে জানান, ১ লাখ ৯৮ হাজার ৬৫৬ জন ভোটার ভোট দিয়েছেন। ৭ হাজার ৩৬৭টি ভোট বাতিল হয়েছে।
অর্থাৎ এবার ভোটের হার ৬২ শতাংশের কাছাকাছি; গতবারও ভোটের হার ৬২ শতাংশই ছিল।
১৩২ কেন্দ্রে আরিফুল ধানের শীষে ভোট পেয়েছেন ৯০ হাজার ৪৯৩টি; অন্যদিকে নৌকা প্রতীকে কামরান পেয়েছেন ৮৫ হাজার ৮৭০টি।
তাদের দুজনের ভোটের ব্যবধান ৪ হাজার ৬২৬।
দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধানের চেয়ে স্থগিত কেন্দ্রের ভোট সংখ্যা কম হলে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে এগিয়ে থাকা প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করতে দেখা যায়।
কিন্তু সিলেটে স্থগিত কেন্দ্র দুটির মোট ভোট সংখ্যা একটু বেশি, ৪৭৮৭টি। অর্থাৎ দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধানের চেয়ে ১৬১টি ভোট বেশি রয়েছে স্থগিত কেন্দ্র দুটিতে।
যে কারণ দেখিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা আলীমুজ্জামান বিজয়ী ঘোষণা করেননি আরিফুলকে।
এখন কী হবে?
রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেছেন, স্থগিত দুটি কেন্দ্রে পুনরায় ভোট গ্রহণের নির্দেশ দেবে নির্বাচন কমিশন।
সাধারণত মাস খানেকের মধ্যে এই ধরনের স্থগিত কেন্দ্রে পুনরায় ভোটগ্রহণ হয়। সেই ভোটগ্রহণের পর এই ভোটের সঙ্গে প্রার্থীর নতুন ভোট যোগ হবে। তারপরই হবে চূড়ান্ত ফল।
২৪ নম্বর ওয়ার্ডের গাজী বোরহান উদ্দিন (রহ.) মাদ্রাসা (১১৬ নং কেন্দ্র) ও ২৭ নং ওয়ার্ডের হবিনন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৩৪ নং কেন্দ্র) কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়।
গাজী সৈয়দ বোরহান উদ্দিন (রহ.) মাদ্রাসা কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ২ হাজার ২২১ জন এবং হবিনন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ২ হাজার ৫৬৬ জন।
এই দুই কেন্দ্রের ভোটারদের আবার ভোট দিতে হবে এবং তাতেই নির্ধারিত হবে পরবর্তী মেয়র কে হবেন।
কামরানের সম্ভাবনা কতটুকু?
গত বার আরিফুলের কাছে হেরে যাওয়া কামরানের এবার এই অবস্থা থেকে জয়ী হওয়া অনেকটা অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো ঘটনা বলতে হবে।
সার্বিক ভোটের হার (৬২ শতাংশ) যদি স্থগিত দুটি কেন্দ্রে পুনঃভোটের সময় বজায় থাকে, তাহলে ৩ হাজারের মতো ভোট পড়তে পারে। এই সব ভোট যদি নৌকা প্রতীকে পড়ে, আরিফুল যদি একটি ভোটও না পান, তাতেও তার হারার কোনো সম্ভাবনা নেই।
কামরানকে জিততে হলে ৪৮৮৭ জন ভোটারের মধ্যে কমপক্ষে ৪৭২৬ জনকে ভোট কেন্দ্রে নিতে হবে এবং তাদের সবার ভোট নৌকায় পড়তে হবে। এই ভোটের একটি বাতিল হলেও চলবে না।
৪৭২৬টি ভোটের চেয়ে একটি কম পড়লে কিংবা কোনো ভোট আরিফুলের ধানের শীষে পড়লেই কামরানের সম্ভাবনা উবে যাবে।
আর ওই দুই কেন্দ্রের সব ভোটার যদি ভোট দেন, তাতে আরিফুলকে জয়ী হতে হলে মাত্র ১৬২টি ভোট পেলেই চলবে।
৩ লাখ ভোটারের মধ্যে ৯০ হাজার ভোট পাওয়া আরিফুল ৪৭২৬টি ভোটের মধ্যে একটিও পাবেন না, এমন সম্ভাবনাও নেই বললেই চলে।
ফলে গণিতের হিসেবে জয়ের সম্ভাবনা দুজনেরই থাকলেও বাস্তব চিত্র আরিফুলের পক্ষেই যায়।
তারা কী বলছেন?
ফল ঘোষণা না হলেও মধ্যরাতে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে আরিফুল বের হওয়ার সময় তার সমর্থকরা জয়োল্লাসই করছিল।
১৩২ কেন্দ্রের ফল ঘোষণার পর লিখিত অনুলিপির জন্য আরও প্রায় আধা ঘণ্টা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে অবস্থান করেন আরিফুল হক। সোয়া ১২টার দিকে নেতাকর্মীদের নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় ত্যাগ করেন তিনি। এসময় উপশহর এলাকার সড়কে থাকা কয়েক হাজার নেতাকর্মী উল্লাস শুরু করে।
আরিফুল সাংবাদিকদের বলেন, “তারা সারাদিন চেষ্টা করেছে লোকজন যেন ভোটকেন্দ্রে না আসে। কিন্তু মানুষকে দূরে রাখা যায়নি। তারা এসেছেন এবং ভোট দিয়েছেন। এ বিজয় জনগণের বিজয়।”
ফল প্রত্যাখ্যানের অবস্থান থেকে সরে আসছেন কি না- এই প্রশ্নে বিএনপি প্রার্থী বলেন, “এটা ফলাফল প্রত্যাখান না। যেখানে কেন্দ্র দখল হয়েছে, যেখানে জাল ভোট হয়েছে, যেখানে ভোটারদের বাধা দেওয়া হয়েছে, আমি সেসব বিষয়কে ঘৃণা জানিয়েছি।”
আওয়ামী লীগের প্রার্থী কামরান এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তবে তার প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ ছিলেন উপস্থিত।
ফল ঘোষণায় যখন আরিফুল এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন রাত ১১টায় মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে ভোট পুনর্গণনার দাবি তোলেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা নির্বাচনের ফলাফল স্থগিত, ভোট পুনর্গণনা এবং কয়েকটি কেন্দ্রে পুনরায় ভোট নেওয়ার জন্য বলেছি। কারণ এখানে যে ফলাফল ঘোষণা করা হচ্ছে কেন্দ্রে আমাদের পোলিং এজেন্টদের দেওয়া ফলাফলের সঙ্গে মিলছে না।”
রিটার্নিং কর্মকর্তা বিষয়টি ‘দেখবেন’ বলে আশ্বস্ত করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর এজেন্টকে। তার আধা ঘণ্টার মধ্যে ১৩২টি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করেন তিনি।
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি কামরানের সঙ্গে এটা আরিফুলের দ্বিতীয় ভোটযুদ্ধ। ২০১৩ সালে প্রথম লড়াইয়ে কামরানকে ৩৫ হাজার ভোটে হারিয়েছিলেন আরিফুল।
তার আগে পাঁচ বছর কামরান ছিলেন সিলেটের মেয়রের চেয়ারে। তারও আগে সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।