শুক্রবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নাগরিকরা তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পর ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জানাজা শেষে বিকালে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হয়।
শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে নাগরিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন পর্বটি শুরু হয় সকাল ১১টায়।ব্যক্তিগত পর্যায়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
“আমি তাকে একজন প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী হিসেবে চিনি। কোথায় কীভাবে কথা বলতে হবে, তিনি সবসময় সাবধানতা অবলম্বন করতেন। কখনও কোথাও কথা বলতে গেলে তিনি তা লিখে আনতেন, লিখে না আনলেও বক্তব্যের আগে কিছু লিখতেন, তা অনুসরণ করে তিনি ব্ক্তব্য দিতেন।
“তার মধ্যে যে ব্যাপারটি লক্ষ্যণীয়, তা ছিল সিস্টেমেটিক ও ডিসিপ্লিন লাইফ লিড করা। তিনি উৎকর্ষতার চেষ্টা করতেন সবসময়, কিছু একটা করলে তার উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা করতেন। বলা যায়, তিনি তার জীবনটি উৎকর্ষভাবেই যাপন করেছেন।”
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দলটির সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
মুস্তাফা নূরউল ইসলামকে সাহিত্য-সংস্কৃতির ‘বরপুত্র’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সংস্কৃতির সব শাখায় ছিল তার অবাধ বিচরণ। তিনি যা লিখে গেছেন তাতে আমরা তার সততা, প্রতিভা আর সৃজনশীলতার স্বাক্ষর পাই। ”
সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, “আমরা সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের এক মহীরুহকে হারিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ বা বাঙালি চেতনার কথা যদি বলি, তবে সারা জীবন সে চেতনা লালন করেছেন, সৃজনকর্মে তিনি তা তুলে ধরেছেন বারবার।”
অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক পদ ছাড়াও জাতীয় জাদুঘর ও নজরুল ইনস্টিটিউটে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে তাকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, “স্বৈরশাসকেরা চেয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর পক্ষের লোক মুস্তাফা নূরউল ইসলামকে সরিয়ে দিতে, পরে তা পেরেছিলও বটে। কিন্তু এই স্বৈরশাসকদের কাছে তিনি কখনও মাথা নত করেননি।”
‘মুক্তধারা’ ও ‘বাঙালির বাংলা’ নামে বিটিভিতে দুটি অনুষ্ঠান নির্মাণের পর এটিএন বাংলায় ‘কথামালা’নামে একটি অনুষ্ঠান নির্মাণ ও উপস্থাপন করেছিলেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বলেন, “সাতচল্লিশ ও আটচল্লিশে তরুণ বয়সে তিনি যেমন নির্ভীক ও সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন, পরিণত বয়সে এসেও তিনি একই ভূমিকা রেখেছেন। মৌলবাদের উত্থান ও স্বৈরশাসনের বিপরীতে তার আদর্শ আমাদের অণুসরণীয়।”
শ্রদ্ধা জ্ঞাপন অনুষ্ঠান এসেছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, প্রাবন্ধিক-গবেষক মফিদুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান ও বাংলাদেশ কর্ম কমিশনের সচিব আখতারী মমতাজ।
শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ কবিতা পরিষদ, আবৃত্তি সংগঠন বাকশিল্পাঙ্গন, খেলাঘর।
সবশেষে অধ্যাপক মুস্তাফা নূর উল ইসলামের জ্যেষ্ঠ ছেলে মুস্তাফা ইমরুল কায়েস তার বাবার বই ও গবেষণাপত্রগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণের অনুরোধ জানান।
পরে সমাপনী বক্তব্যে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ জানান, ১৪ মে বিকাল ৪টায় বাংলা একাডেমিতে মুস্তাফা নূর উল ইসলাম স্মরণে এক নাগরিক স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে, যাতে সভাপতিত্ব করবেন ইমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পর বাঙালির ভাষা অধিকার রক্ষার আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বুধবার রাতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নিজ বাসভবনে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।
তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থগুলো থেকে জানা যায়, ছাত্র বয়স থেকেই দিনাজপুর-রংপুর অঞ্চলের তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি । ১৯৪৮-১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি প্রতিবাদী ও প্রতিরোধী আন্দোলনের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
ষাটের দশকের আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের পর ৬১’তে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে তিনি পালন করেন অগ্রণীর ভূমিকা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, মুস্তাফা নুরউল ইসলাম তখন লন্ডনে পিএইচডি গবেষণা করছিলেন। প্রবাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
মুস্তাফা নূরউল ইসলামের কর্মজীবন শুরু সাংবাদিকতা দিয়ে , পরে ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা শুরু করেন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনা করেছেন করেন।
জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের প্রবন্ধ-সঙ্কলন ও গবেষণা গ্রন্থের সংখ্যা ৩০টির অধিক।
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ‘সুন্দরম’ নামে ত্রৈমাসিক পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন।