বিদায়ী এপ্রিল মাসজুড়েই সারাদেশ দেখেছে কালবৈশাখী ঝড় আর বজ্রপাতের দাপট; মাসের শেষ দুদিনেই বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে মারা গেছেন অন্তত ৩৩ জন।
Published : 01 May 2018, 12:25 AM
এবার চৈত্রের মাঝামাঝি ৩০ মার্চ থেকে রাজধানীসহ গোটা দেশে ঝড়-শিলাবৃষ্টির দাপট শুরু হয়। সেই সঙ্গে দেখা দেয় বজ্রপাত।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই এপ্রিল মাসটায় বেশ কালবৈশাখী, বজ্রঝড় বয়ে গেল। গত কয়েক বছরে এমন বজ্রঝড়ময় মাস হাতে গোনা।
“এবার শীতকালটাও ছিল অস্বাভাবিক। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ এলাকায় কালবৈশাখীর মওসুমেও ছিল তীব্রতা। একেবারেই স্বাভাবিক বলা যাবে না।”
তিনি বলেন, কিছুটা ‘ভিন্নরূপ’ দেখা যাচ্ছে আবহাওয়ায়। মার্চ-এপ্রিল মাসে যেখানে ঘূর্ণিঝড়প্রবণ সময়, সেখানে বায়ুস্তরে ‘এন্টি সাইক্লোন মুভমেন্ট’ দেখা যাচ্ছে।
“সাইক্লোনের উল্টোগতি বা এন্টি সাইক্লোন ওয়েদারে বাতাসে জলীয় বাষ্প প্রচুর হয়। এতে বজ্রঝড় বেড়ে যায়। চলতি এপ্রিল মাসেও এর প্রভাব বেশি ছিল।”
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ড. সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে এপ্রিল মাসে তীব্রঝড় ও বজ্রপাতের প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ১৯৮০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ডেটা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মার্চ ও এপ্রিল মাসে ঝড়-বজ্রপাতের প্রবণতা কম ছিল। মে সাসে এমন ঝড়ো বজ্রপাত বেশি দেখা যেত।
“আমি দেখছি, ২০০১ সাল থেকে গত ১৫ বছরে মাঝে মাঝেই এপ্রিল মাসে কখনও কখনও তীব্রতা বেড়েছে। এপ্রিলে এমন বজ্রঝড়ের বেশি প্রবণতা মানে একটু আগাম ঘটছে তা।”
বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ দুর্বল থাকলেই বাংলাদেশের উপর বজ্রঝড়ের প্রবণতা বাড়ছে, বলেন এই গবেষক।
তবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস কর্মকর্তা নাজমুল হকের কাছে এবারের এপ্রিলে ঝড় ও বজ্রপাতের ব্যাপকতা অস্বাভাবিক ঠেকছে না।
তিনি বলেন, “গেল বছর এপ্রিলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ছিল, উত্তরের অকাল বন্যা ছিল। এবারও তাও ঘটেনি। অনেকের কাছে বজ্রঝড় ও কালবৈশাখীর প্রবণতা বেশি মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে অস্বাভাবিক ছিল না। স্বাভাবিক ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে।”
বজ্রপাতে এই সময়টাতে মৃত্যু বেশি হওয়ার সঙ্গে ফসলের মওসুমের যোগসূত্রের কথাও বলেন ড. সমরেন্দ্র কর্মকার।
তিনি বলেন, “এপ্রিল-মে মাস ও নভেম্বর-ডিসেম্বরে মাঠে উঠতি ফসল থাকে। এমন পিক সময়ে কৃষকরা মাঠে থাকবেই।”
গত কয়েকদিনে হতাহতের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিহতদের অধিকাংশ ঝড়-বৃষ্টির সময় ফসলের ক্ষেতে ছিলেন।
বাংলাদেশের বুয়েট ও ব্যাংককের রিজিওনাল ইন্টিগ্রেটেড মাল্টি-হ্যাজার্ড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম-এ কর্মরত বিজ্ঞানী ড. মোহন কুমার দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ঝড় ও বজ্র বৃষ্টি হয় এপ্রিল ও মে মাসে। এ সময় ৬১ থেকে ৯০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া ঝড়ের সংখ্যা বেশি।
এপ্রিলের তীব্রঝড়-বৃষ্টি ও তাপমাত্রা
>>আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ১৯৮৮ সালের এপ্রিলে প্রতি ঘণ্টায় ১১১ কিলোমিটার, ১৯৯৫ সালে ১১৩ কিলোমিটার, ১৯৯৮ ও ২০১৭ সালে ৯৩ কিলোমিটার। এবার এপ্রিলে ঢাকায় সর্বোচ্চ ৮৩ কিলোমিটার বেগে ঝড় বয়ে যায়।
>> এপ্রিল মাসে দেশের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ১২৭ মিলিমিটার। ২০১৪ সালে স্বাভাবিকের চেয়ে ৭৯% কম, ২০১৫ সালে ৩৩% বেশি, ২০১৬ সালে ৫১% কম এবং ২০১৭ সালে ১০৪% বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এবারও স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
>> এবারের এপ্রিলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১৫ ও ২০১৬ ১৬ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০১৭ সালের এপ্রিলে ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ড. মোহন জানান, ভারতের বিহারে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করে এমন কালবৈশাখীর ঘটনাকে বিজ্ঞানীরা ‘এ’ টাইপ নাম দিয়েছেন, যার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে।
বজ্রঝড়ের সময় সাধারণত ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট বজ্রপাতের ভয় থাকে। কালবৈশাখী ঝড় ও বজ্রপাত শুরুর অন্তত আধ ঘণ্টা সময় সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, মে মাস থেকে ঝড়-বৃষ্টির প্রবণতা ধীরে ধীরে কমতে পারে।
বজ্র ঠেকাতে তালগাছ
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহাম্মদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে আড়াইশ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ মানুষ মারা যায় বজ্রপাতে।
এটাকে দুর্যোগ ঘোষণার পর জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ২০১৭ সাল থেকে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার; তার একটি হচ্ছে তালগাছ রোপণ।
রিয়াজ বলেন, “গেল ভাদ্র মাস থেকে চলতি বৈশাখ পর্যন্ত (সেপ্টেম্বর-এপ্রিল) সারাদেশে সাড়ে ৩১ লাখ তাল বীজ বপন করা হয়েছে। এগুলো বড় হতে সময় লাগবে আরও ৫-৬ বছর। এরই মধ্যে আমরা ব্যাপক জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম নিয়েছি।”
সর্বত্র তালগাছের সংখ্যা বাড়লে বজ্রপাত সেখানেই হবে, ফলে এড়ানো যাবে প্রাণহানি।
বজ্রপাত থেকে রক্ষায় তালগাছ লাগানোর উপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছিলেন, “বজ্রপাত ইদানিং দেখা যাচ্ছে খুব বেশি।…তালগাছের একটা গুণ আছে। বজ্রপাত হলেই সেটা আগে তাল গাছের উপর পড়ে। আমাদের আবার তালগাছ লাগানো শুরু করা উচিৎ।”
বজ্রঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি ও তা ঠেকাতে উদ্যোগের বিষয়ে সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, ব্যাপক সচেতনতার অভাব, বিপুল জনসংখ্যা, পর্যাপ্ত গাছপালা না থাকা ও কৃষিচক্রের পরিবর্তনের কারণে বজ্রপাতে জানমালের ক্ষতি এড়ানো যাচ্ছে না।
ড. মোহন বলেন, “সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হচ্ছে কালবৈশাখীর সময় করণীয় বিষয়ে জনসচেতনতা। কালবৈশাখী ও বজ্রঝড়প্রবণ এলাকায় এ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ ও ড্রিলের ব্যবস্থা জরুরিভিত্তিতে করা দরকার।”
সচেতনতা
>> বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, খোলা মাঠ বা উচুঁ স্থানে না থাকাই ভালো।
>> বজ্রপাতের সময় চামড়ার ভেজা জুতা বা খালি পায়ে থাকা বিপজ্জনক। একান্ত বের হতে হলে রাবারের জুতো ব্যবহার করা উচিত।
>> বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা খোলা মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি হাঁটু গেড়ে, কানে আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়া উচিত।
>> যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। টিনের চালা যথা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে।
>> উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক তার বা ধাতব খুঁটি, মোবাইল ফোনের টাওয়ার থেকে দূরে থাকাই নিরাপদ হবে।
>> কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা বা জলাশয় থেকেও দূরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
>> বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতরে থাকলে, ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ এড়িয়ে চলতে হবে। সম্ভব হলে গাড়ি নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে।
>> বাড়িতে থাকলে বজ্রপাতের সময় জানালার কাছাকাছি বা বারান্দায় থাকা নিরাপদ হবে না।
>> বজ্রপাতের সময় বাড়ির জানালা বন্ধ রাখা উচিত। ঘরের ভেতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকেও দূরে থাকা প্রয়োজন।
>> মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ল্যান্ডফোন, টেলিভিশন, ফ্রিজসহ সকল বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সেগুলো বন্ধ রাখতে হবে।
>> ধাতব হাতলের ছাতা ব্যবহার না করাই ভালো।
>> বজ্রপাতের সময় ছাউনিহীন নৌকায় মাছ ধরতে যাওয়া নিরাপদ নয়। ওই সময় নদীতে থাকলে নৌকার ছাউনির নিচে থাকা উচিত।
>> বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ না করাই নিরাপদ।
>> বিপদ এড়াতে প্রতিটি ভবনে বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন নিশ্চিত করতে হবে।