‘এই বয়সে এত কষ্ট কীভাবে সইবে মাহি’

বিমান দুর্ঘটনায় পাইলট বাবার মৃত্যুর ১১ ‍দিনের মাথায় স্ট্রোক করে মারা গেলেন মা; আবিদ সুলতান ও আফসানা খানম দম্পতির এমন মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ তাদের কিশোর সন্তান তানজীব বিন সুলতান মাহি।

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 March 2018, 05:16 PM
Updated : 23 March 2018, 06:02 PM

শুক্রবার আফসানার লাশ উত্তরার বাসায় নেওয়ার পর সেখানে ছুটে আসেন আত্মীয়-স্বজন আর প্রতিবেশীরা।

সেখানে আবিদ-আফসানার একজন পারিবারিক বন্ধু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার ছেলেটা মাহির সাথে পড়ে। এতটুকু ছেলে কীভাবে এত কষ্ট সহ্য করবে? বাবা-মার কত আদরের ছেলে ও। অথচ এখন বাবা-মাকে ছাড়াই থাকতে হবে।”

স্বামীর মৃত্যুর খবর আসার পর সপ্তাহ না কাটতেই স্ট্রোকের পর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন আফসানা। তখন থেকেই উত্তরায় নিজেদের বাসা ছেড়ে মিরপুরে নানা ও চাচার বাসায় ছিলেন মাহি।

সকালে মায়ের মৃত্যুর পর আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে আনা হয় মাহিকে । সে সময় সেখানকার চিকিৎসক চাচা খুরশীদ আলমের কক্ষেই ছিলেন তিনি। দুপুরে মায়ের কফিনের সঙ্গে উত্তরার বাসায় আসেন মাহি।

উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর সড়কের ওই বাসায় আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে এসেছিলেন মাহির বন্ধু ও তাদের বাবা-মায়েরা। স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে সেখানে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এ সময় শোকাতুর মাহি একেবারেই নিশ্চুপ ছিলেন।

মা-বাবার মৃত্যু শোক সইতে পারবে না ভেবে প্রথমে তাকে মায়ের মরদেহ দেখতে দেওয়া হয়নি। জানাজার জন্য মরদেহ নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে শেষবার মায়ের মুখ দেখেন মাহি।

পরে জানাজার জন্য লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে আফসানার মরদেহ নেওয়া হয় উত্তরা গাউসুল আজম জামে মসজিদে। চাচা খুরশীদ আলমের সঙ্গে ওই গাড়িতে মাহিও ছিলেন।

একমাত্র ছেলে মাহিকে একা রেখেই চলে গেলেন আবিদ সুলতান ও আফসানা খানম

জানাজার পর সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে আফসানার মরদেহ নেওয়া হয় বনানীর সামরিক কবরস্থানে, যেখানে গেল সপ্তাহেই সমাহিত করা হয়েছে আবিদ সুলতানকে। স্বামীর কবরের পাশেই দাফন করা হয় আফসানাকে।

মায়ের দাফনে এসে গাড়ি থেকে নেমে চাচার পাশে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন মাহি। পরে গাড়িতে গিয়ে বসেন আরেক নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে। মাগরিবের নামাজের পর মাকে দাফনের সময় পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন মাহি। এ সময় তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে।

চাচা খুরশীদ আলম মাহির হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সারাদিনই মাহির পাশে দেখা গেছে তাকে।

উত্তরার মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ‘ও’ লেভেলের ছাত্র মাহি এখন থেকে এই চাচার মিরপুরের বাসায় থাকবেন বলে তার মায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জেসরিন চৌধুরী শিউলি জানিয়েছেন।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে বাবা-মা, এতদিনের ঠিকানা হারানো মাহির আগামী দিনগুলো কেমন কাটবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন তার বন্ধু, আত্মীয়-স্বজনরা।  

এক ছেলেকে নিয়ে আবিদ-সুলতানার সংসার ‘খুব সুখের’ ছিল জানিয়ে তাদের প্রতিবেশী মারিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এভাবে কারও মৃত্যু হয় আগে দেখিনি। অনেকে এক্সিডেন্টে একসাথে মারা যায়। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর খবরে এভাবে কাউকে মারা যেতে দেখিনি।

“সাজানো সংসারটা কীভাবে ভেঙে গেল। বাবা-মা দুজনই মারা গেল, ছেলেটার জন্য চিন্তা হয়। এই বয়সে ওকে কত কিছু সহ্য করতে হচ্ছে। ওর কী হবে?”

এই পরিবারের ঘনিষ্ঠ আরেক নারী বলেন, “উনি (আফসানা) কান্না চেপে রেখেছিলেন, নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেছেন, এতেই স্ট্রোকটা হয়।

“আসলে আংকেল-আন্টির সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। আংকেলকে ছাড়া থাকতে চাননি বলেই হয়ত চিরতরে চলে গেছেন।”

ইউএস-বাংলার একটি উড়োজাহাজ গত ১২ মার্চ কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হলে ২৬ বাংলাদেশিসহ ৪৯ জনের মৃত্যু হয়। ওই ফ্লাইটের প্রধান বৈমানিক ছিলেন বিমান বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা আবিদ সুলতান। স্বামীর মৃত্যুর খবরে ‘স্ট্রোক’ হলে ১৮ মার্চ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আফসানাকে।

আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী-সবার কাছেই সদা হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন আফসানা খানম।

মাহির বন্ধু মিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আন্টি খুব জলি মাইন্ডের ছিলেন। আংকেল মারা গেলেন, আর উনিও যে এভাবে চলে যাবেন, চিন্তাই করিনি। মাহির জন্য খুব খারাপ লাগছে।

“মনে হচ্ছে, আমাদের সাথে এমন হলে কী করতাম?”

মাহি বরাবরই চুপচাপ থাকতে পছন্দ করেন জানিয়ে তার মাস্টারমাইন্ডের এই সহপাঠী বলেন, “ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন আংকেল (আবিদ সুলতান)। আর আংকেলই তো চলে গেলেন।”

ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র আবিদ সুলতান এক সময় বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের বৈমানিক ছিলেন। তাদের গ্রামের বাড়ি নওগাঁর রানীনগরে। বাবা এম এ কাশেমও ছিলেন বৈমানিক।

আর আফসানাদের গ্রামের বাড়ি নাটোরে। তার বাবা এ কাশেম শেখ একজন চিকিৎসক।  আফসানার এক বোন আমেরিকা প্রবাসী, আর একমাত্র ভাই থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়।