‘আবিদ ভাইয়ের বাসায় এভাবে আসতে হবে ভাবিনি’

নেপালে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় বৈমানিক স্বামী আবিদ সুলতানের মৃত্যুর ধাক্কা না কাটতেই তার শোকাতুর স্ত্রী আফসানা খানমের স্ট্রোকের পর স্বজন আর কাছের মানুষদের সময় কাটছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 March 2018, 11:05 AM
Updated : 21 March 2018, 12:35 PM

স্বামীর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর স্ট্রোক করে চারদিন ধরে হাসপাতালে অসাড় পড়ে আছেন আফসানা। তাকে দেখতে প্রতিদিনই ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে আসছেন স্বজন-বন্ধুরা।  

কাঠমান্ডুর ওই দুর্ঘটনায় সাজানো পরিবারটির বিপর্যস্ত অবস্থায় এই দম্পতির একমাত্র সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা।

হাসপাতালে কথা হল আফসানার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জেসরিন চৌধুরী শিউলির সঙ্গে। গত ১২ মার্চ বিমান দুর্ঘটনার খবর পেয়ে চট্টগ্রামের হালিশহর থেকে ছুটে আসেন বান্ধবীর আফসানার কাছে। দুর্ঘটনার পরদিন মঙ্গল থেকে শনিবার পর‌্যন্ত ছিলেন আবিদ-আফসানার বাসায়।

“শনিবার আমি ওর বাসা থেকে চলে আসি। আমাকে কোনোভাবে আসতে দিতে চাচ্ছিল না। এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। যদি না আসতাম, তাহলে হয়তো এমন হতো না। ও এতোটা অসুস্থ হয়ে পড়বে চিন্তাই করিনি। ভাইয়াকে হারানোর ধাক্কাটা সহ্য করতে পারেনি।

আবিদ-আফসানার পরিবারের সাথে এমন অনেক স্মৃতিই এখন পোড়ায় বন্ধু জেসরিন চৌধুরী শিউলিকে

স্মৃতিকাতর শিউলি বলেন, “ওর সাথে কত ছবি, কত স্মৃতি। ১৬ বছরের সম্পর্ক আমাদের। ঢাকায় আমার ভাই, খালা, মামা- সবাই থাকে। কিন্তু ঢাকায় আসলে ও কখনো আমাকে অন্য কোথাও থাকতে দিত না। ওর বাসায়ই থাকতে হবে।”

কথা ফাঁকে মোবাইল ফোনে তোলা আফসানার সঙ্গে নিজের ছবিও দেখান শিউলি। দুই পরিবারের একসাথে বান্দরবান বেড়ানোর ছবি, আরো কত ছবি।

আইসিইউর বাইরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেন প্রতিদিনই তিনি। প্রহরী, নার্সদের কাছে কাকুতি-মিনতি করেন, কিন্তু দেখার সুযোগ মেলে না। অবশেষে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বান্ধবীকে দেখার সুযোগ পান।

আবিদ সুলতানের মৃত্যুর পর আফসানার ভেঙ্গে পড়ার কথা জানান তিনি।

“ভাইয়ার মৃত্যুর খবরে ও নির্বাক হয়ে গেছিল। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিছিল, লিকুইড খাবার জোর করে খাওয়ানো হচ্ছিল। তবে সুস্থ ছিল। ওর আসলে চিৎকার করে কাঁদার দরকার ছিল। ও শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। শোকটা সহ্য করতে পারেনি।

"আবিদ ভাই ছিল খুবই সহজ সরল। কোনো রাগ ছিল না। কেউ যদি ওনাকে মেরেও চলে যায়, তাও উনি কিছু বলবে না। খুব ভাল মানুষ ছিলেন।"

গত ৬ মার্চও আফসানার বাসায় এসেছিলেন শিউলি।

আবিদ-আফসানার পরিবারের সাথে এমন অনেক স্মৃতিই এখন পোড়ায় বন্ধু জেসরিন চৌধুরী শিউলিকে

“গত দুই মাসে তিনবার ওর বাসায় আসছি। দুইবার আসছি হাসিমুখে। কিন্তু শেষবার আসতে হল কান্না করে। এভাবে আসতে হবে ভাবিনি।”

“আমাদের এতো এতো ছবি- এখন শুধুই স্মৃতি। ভাইয়া চলে গেল। আফসানাও মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। ও ফিরে আসুক আমাদের কাছে- এর বাইরে আর কোনো চাওয়া নেই।"

আবিদ-আফসানার ছেলে তানজিদ সুলতান মাহির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "বাবা মারা গেছে, মায়ের অবস্থাও ভাল না। ও বিষন্ন থাকে। এমনিতে ভাল আছে।"

আবিদ-আফসানার সন্তান মাহির সঙ্গে মাস্টারমাইন্ড ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে নূরজাহানের ছেলে গালিব। নূরজাহানও এসেছিলেন হাসপাতালে।

মাহির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, "মে মাসের ১১ তারিখে মাহির ও লেভেল ফাইনাল পরীক্ষা। এখন ভয় লাগছে যে, ও কীভাবে রিকভার করবে? আমরা চিন্তা করছি, ওর মায়ের শোকটা ও নিতে পারবে কিনা।"

আবিদ-আফসানার পরিবারের সাথে এমন অনেক স্মৃতিই এখন পোড়ায় বন্ধু জেসরিন চৌধুরী শিউলিকে

কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, "এতো সুন্দর একটা ফ্যামিলি। অথচ কি হয়ে গেল। আবিদ ভাই মারা গেল। ভাবিরও যা অবস্থা, ছেলেটার কী হবে? এতো বড় ধাক্কা ও সইবে কী করে?"

মাহি এখন তার ছোট খালার বাসায় থাকছে বলে জানান তিনি।

আফসানার তিন বোন এক ভাই। বড় বোন মারা গেছেন দুই বছর আগে। ছোট বোন থাকতেন দেশের বাইরে। আবিদের মৃত্যুর খবরে তিনিও ছুটে এসেছেন দেশে।

এদিকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক বদরুল আলম বুধবার জানিয়েছেন, আফসানা খানমের অবস্থার এখনো কোনো পরিবর্তন নেই।